চাঁপাই চিত্রের নির্বাহী সম্পাদক বন্ধুবর অলিউজ্জামান রুবেল ফোনালাপে বলেছিলেন, ভালো যে কোনো বিষয়ই কলামে তুলে ধরতে। তার কথার সূত্র ধরেই এ লেখার উপক্রম। যদিও এ ধরনের লেখার ক্ষেত্রে ব্যক্তির গুণগান অনেক সময় চলে আসে, সেটা প্রয়োজনের তাগিদেই। কিন্তু দুঃখের বিষয়, অনেকেই আবার একে বাঁকা চোখে বিরূপ মন্তব্য করেন; যা এর আগে চাঁপাই চিত্রে প্রকাশিত এক লেখার পর ঘটেছিল। সবিনয়ে তাদের জানিয়েছিলাম, লেখার কোনো প্রতিক্রিয়া থাকলে সেটা ইতিবাচকই হোক
আর নেতিবাচকই হোক, তা পত্রিকায় পাঠান। আপনাদের আলোচনা-সমালোচনা আগামীতে পরিচ্ছন্ন লেখা লিখতে সহায়ক হবে।আজকের লেখার যে বিষয়টি, সেটি আরো আগে বিশেষ প্রতিবেদন হিসেবে প্রকাশিত হতে পারত। সাংবাদিকদের কাজই ভালোকে ভালো বলা, খারাপকে খারাপ। শুধু নেতিবাচক খবরই প্রকাশিত হবে, তা নয়। ইতিবাচক খবর প্রকাশও জরুরি; যাতে সাধারণ মানুষের জানতে সুবিধে হয়। যাহোক। এবার আসি মূল লেখায়।
ভূমি বা জমি সম্পর্কে তেমন কোনো স্বচ্ছ ধারণা কোনো কালেই ছিল না। এখনো পুরোপুরি ধারণা তৈরি হয়নি। তবে ২৬-২৮ জানুয়ারি নাচোল উপজেলা পরিষদ চত্বরে অনুষ্ঠিত ‘ভূমি সেবা সপ্তাহ-২০১৬’ এর মাধ্যমে কিছুটা হলেও ধারণা লাভ করতে পেরেছি। এজন্য উপজেলা ভূমি অফিস তথা সহকারী কমিশনার (ভূমি) সরকার অসীম কুমার সাধুবাদ পেতেই পারেন। অবশ্য শুধু আমার কাছেই নয়; ধারণা, এরই মধ্যে নাচোলবাসীর বিশেষত যারা জমি নিয়ে সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকেন, তাদের কাছ থেকেও সাধুবাদ পেয়েছেন ওই আয়োজনের জন্য। ভূমি সেবা সপ্তাহ আয়োজন— নাচোলে এই প্রথম। এর আগে কখনো হয়নি তা নিশ্চিত হয়েছি সেখানকার স্থানীয় জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আবদুস সাত্তারের মারফত।
ভূমিসেবা সপ্তাহ উপলক্ষে পরিষদ চত্বরে উপজেলাসহ প্রত্যেক ইউনিয়ন ভূমি অফিসের স্টল ছিল। স্টল ছিল ভূমি বা ভূমি আইনসম্পর্কিত বইপুস্তকের। নাচোলবাসীকে ভূমিসেবা বা ভূমিসম্পর্কিত বিষয়ে ধারণা দেয়ার জন্য উপজেলা ভূমি অফিস এ উপলক্ষে একটি পুস্তিকা ও চারটি লিফলেট বা প্রচারপত্র প্রকাশ করেছিল; যা সাধারণ মানুষের জন্য অতীব জরুরি, ভূমি আইন বা এ সম্পর্কে জ্ঞানলাভের জন্য। প্রচারপত্রগুলো পড়ে সাধারণ মানুষ সহজেই বুঝতে বা জানতে পারবে খাস জমি ও ভূমিহীনের সংজ্ঞা, বন্দোবস্ত বাতিল, জলমহাল ইজার পদ্ধতি, অর্পিত সম্পত্তির লিজ প্রদান ও বাতিল, অর্পিত সম্পত্তির শ্রেণিবিভাগ প্রভৃতি। রয়েছে নামজারি বা মিউটেশন সম্পর্কে মূল্যবান কিছু তথ্য এবং সাধারণ মানুষের জন্য ভূমি অফিসের পরামর্শ। নামজারির সেবা মূল্য ও জমির ব্যবহারভিত্তিক শ্রেণী অনুযায়ী করের পরিমাণ কত, তাও উল্লেখ আছে প্রচারপত্রে। এর সুবিধা হলো, ভূমি অফিসের কেউ আর সাধারণ মানুষকে ঠকিয়ে বেশি পয়সা আদায় বা হয়রানি করতে পারবেন না।
প্রচারপত্রে কয়েকটি সেবা, যেগুলো কতটি ধাপে, কতজন জনবল নিয়ে, কত দিনের মধ্যে সম্পন্ন করা হবে তা বলা হয়েছে। প্রাসঙ্গিকভাবেই সেগুলো উল্লেখের দাবি রাখে। ১. আদিবাসীদের জমি হস্তান্তরের অনুমতি প্রদান : ৮টি ধাপে, তিনজন জনবল নিয়ে ৭ থেকে ১৪ দিনের মধ্যে এ সেবার অনুমতি প্রদান। ২. নামজারি-জমাখারিজ : ১৭ ধাপে ছয়জন জনবল নিয়ে সর্বোচ্চ ৪৫ দিন সময়সীমার মধ্যে এ সেবা দেয়া হবে। ৩. নামজারি ও জমাভাগ আদেশের রিভিউ : এটিও আগের সেবার (২) অনুরূপভাবে করা হবে। ৪. ভূমির শ্রেণী পরিবর্তনের আবেদন নিষ্পত্তি : ১০টি ধাপে পাঁচ থেকে সাতজন জনবল নিয়ে এ সেবা ২০ থেকে ২৫ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি। এই যে, সেবাগুলো সম্পর্কে মানুষকে সম্যক ধারণা দেয়ার চেষ্টা; তাতে উপকারভোগীর সংখ্যাই বেশি হবে বৈ কম হবে না।
১৬ পৃষ্ঠার পুস্তিকাতে যেসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রত্যেকের জানাটাও জরুরি। আমরা যারা সংবাদপত্রে কাজ বা লেখালেখি করি, জানাটা তাদের জন্যও প্রয়োজন। অন্তত জমি সংক্রান্ত কোনো সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে তা অবশ্যই কাজে লাগবে। এটাও সত্য যে, দেশের গ্রামাঞ্চলে বেশির ভাগ হামলা-সংঘর্ষ জমিকে কেন্দ্র করেই। আদালতে মামলার বেশির ভাগও জমিজমাকেন্দ্রিক। বলা যায়, এ নিয়ে আদালতে মামলার জটই তৈরি হয়ে আছে। সুতরাং জমি কিনে কাউকে যেন প্রতারিত না হতে হয় তার জন্য এ সম্পর্কিত তথ্য মানুষের জানা দরকার। এ জানাটা আখেরে তাদেরই উপকারে লাগবে। পুস্তিকায় ‘জমি ক্রয়ের পূর্বে ক্রেতার করণীয়’, ‘জমি ক্রয়ের পর ক্রেতা-মালিকের করণীয়’, ‘মিউটেশন বা জমা খারিজ ও নামজারি কি ও কেন প্রয়োজন’, ‘নামজারি ও জমা খারিজ কিভাবে করবেন?’, ‘নামজারি ও জমা খারিজের সুবিধা’, ‘যথাসময়ে নামজারি না করার অসুবিধা’, ‘কোন কোন ক্ষেত্রে মিউটেশন প্রয়োজন’, ‘ভূমি উন্নয়ন কর আদায় কার্যক্রম’, ‘ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোদের কতিপয় বিধান’, ‘লিজকৃত ভি.পি ভূমির শ্রেণী পরিবর্তন/গৃহ নির্মাণ’, ‘ভূমি ব্যবস্থাপনার সাথে সংশ্লিষ্ট অফিস আদালত অর্থাৎ কোন কাজের জন্য কোন অফিসে যেতে হবে’ শিরোনামে তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। শুধু তাই নয়, কোন অফিসের কার কি দায়িত্ব সেটিরও উল্লেখ আছে। যদিও পুস্তিকা অনুযায়ী ভূমিসম্পর্কিত বেশির ভাগ দায়িত্ব জেলা প্রশাসক, সহকারী কমিশনার (ভূমি) এবং তহশিলদার/ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তার ওপরই। ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, ভূমি অফিস কতৃর্ক প্রকাশিত পুস্তিকা ও প্রচারপত্রগুলো প্রত্যেকেরই সংগ্রহ এবং সংরক্ষণ করা উচিত।
একটি প্রচারপত্রে ভূমি অফিস কতৃর্ক সম্পাদিত এবং চলমান ইনোভেটিভ কাজের তালিকা তুলে ধরা হয়েছে। লেখার শিরোনামের যথার্থতা প্রমাণের জন্য সেগুলো তুলে ধরা প্রয়োজন মনে করছি। সম্পাদিত ইনোভেটিভ কাজগুলো হচ্ছে— দ্বিচক্রযান শেড নির্মাণ, বিভিন্ন সেবার প্রসেস ম্যাপ স্থাপন, সচেতনতামূলক ব্যানার ও ফেস্টুন প্রদর্শন, অডিও রেকর্ডিংয়ের মাধ্যমে জনগণকে ভূমিসেবা সম্পর্কে ধারণা প্রদান, নামজারি ও মিস কেস ক্যালেন্ডার স্থাপন, মূল্যবান কাগজপত্র প্লাস্টিক ফোল্ডারের মাধ্যমে সেবাপ্রার্থীদের প্রদান, ডিজিটাল গার্ড ফাইল সংরক্ষণ, সেবাপ্রার্থী কতৃর্ক ভূমি অফিসের বিভিন্ন সেবা মূল্যায়ন ছকবিষয়ক কার্যক্রম, রেকর্ডরুমে বিভিন্ন নথি সুবিন্যস্তকরণ ও মিসিং নথি তালিকা নোটিশ বোর্ডে প্রদর্শন, হোল্ডিং অনুযায়ী মোবাইল নম্বর সংরক্ষণ, ভূমি ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন রেজিস্টার সরকারি লোগোসহ লালসালুতে বাঁধাই, প্রস্তাবিত খতিয়ান ডিজিটাল পদ্ধতিতে সংরক্ষণ, সিটিজেন চার্টার ও ভূমিবিষয়ক মিনি লাইব্রেরি স্থাপন, গণশুনানি ও তাৎক্ষণিক সেবা প্রদান কার্যক্রম, প্রতিটি ইউনিয়ন ভূমি অফিসের জন্য পৃথক ফাইল কাভার ও ভূমি অফিসের জন্য পৃথক তথ্যসংবলিত ডায়েরি তৈরি, সকল ইউনিয়ন ভূমি অফিসের গাছ নম্বর দিয়ে চিহ্নিতকরণ এবং কাগজি লেবু বাগান স্থাপন।
চলমান ইনোভেটিভ কাজগুলো হচ্ছে— সকল খাস জমির ডাটাবেজ তৈরি, আধুনিক হেল্পডেস্ক স্থাপন, পুকুরের ডাটাবেজ তৈরি, সফটওয়্যারের মাধ্যমে ভূমিসেবা প্রদান, পুকুরপাড় বাঁধাই, ভূমি অফিসের মেইন গেট নির্মাণ, আদিবাসী ভাষায় অডিও রেকর্ডিংয়ের মাধ্যমে ভূমিসেবা সম্পর্কে ধারণা প্রদান, ভূমিসেবা সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য ডিজিটাল পদ্ধতিতে প্রদর্শন, ভূমি জাদুঘর স্থাপন, ভূমিবিষয়ক সাধারণ জ্ঞান/বিতর্ক প্রতিযোগিতা/উপস্থিত বক্তৃতার আয়োজন, শ্রেষ্ঠ ইউনিয়ন ভূমি অফিস, সর্বোচ্চ ভূমি উন্নয়ন করদাতাকে সম্মাননা স্বীকৃতি প্রদান, সেবাপ্রার্থীদের জন্য দর্শনীয় স্থানে ঘড়ি স্থাপন, সকল ইউনিয়ন ভূমি অফিসে অডিও রেকর্ডিং প্রচারের ব্যবস্থা গ্রহণ এবং ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ভূমিসেবা প্রদান। পাঠক বিরক্ত হলে আন্তরিকভাবে দুঃখিত। তবে এসব কাজ যদি দ্রুত সম্পন্ন হয়; তাহলে ভূমি অফিসের দৃশ্যটা কেমন হতে পারে, একবার কল্পনা করুন তো! এসব চালু হলে আর যাই হোক ওই অফিসে ভূমিসেবা পেতে কারো হয়রানি হওয়ার ভয় আর থাকবে না।
এবার আসছি সহকারী কমিশনার (ভূমি) সরকার অসীম কুমার সম্পর্কে। ভদ্রলোকের সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয়েছিল গতবছরের ১৩ অক্টোবর, ঘাসুড়া গ্রামে নাচোলের কিংবদন্তি নেত্রী ইলা মিত্রের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে। প্রথম দর্শনেই তাকে রুচিশীল ব্যক্তি বলে মনে হয়েছিল, যা সে সময় প্রকাশিত এক লেখায়ও উল্লেখ করেছিলাম। সরকার অসীম কুমারের নাচোলে যোগদানের বয়স ৬ মাস পেরিয়েছে। কিন্তু এই অল্প সময়ে তিনি যা করে দেখিয়েছেন, তা এক কথায় অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলা। অবশ্য তার স্বীকৃতি কিছুটা হলেও তিনি পেয়েছেন। গত ২৯ জানুয়ারি ১৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে নাচোল প্রেস ক্লাব তার দক্ষতার স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে সম্মাননা স্মারক প্রদান করেছে।
রুচি ও মননশীল এই ব্যক্তিটি ভূমি অফিসের পুরাতন মাটির ভবন ভেঙে গড়েছেন ফুলের বাগান। বাগানের ভেতর দর্শনার্থীদের বসার জন্য তৈরি করেছেন ছাউনি। ছাউনির নামও দিয়েছেন— ‘ইলা মিত্র ছায়ানীড়’; যা উন্নত মনমানসিকতার ব্যক্তি না হলে এ নাম দেয়া সম্ভবই নয়। বিশুদ্ধ খাবার পানির ব্যবস্থাও করেছেন। যে কেউ বর্তমানে ভূমি অফিসে প্রবেশ করলে মনটি ফুরফুরে হতে বাধ্য, পরিবেশের কারণেই। শুনেছি প্রতি সপ্তাহে একদিন তিনি দর্শনার্থীদের সঙ্গে খোলাখুলি আলাপ করেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার যে ভিশন, তাকে এগিয়ে নিতে পারেন সরকার অসীম কুমারের মতো ব্যক্তিরাই; এতে কারো দ্বিমত করার সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। আর শুধু নাচোলই নয়, দেশের সব ভূমি অফিসগুলো যেন এরকমই হয়; সে প্রত্যাশা অবশ্যই থাকবে।
পরিশেষে নাচোল উপজেলা ভূমি অফিসের বাগানের ফুলগুলো সাধারণ মানুষের আশার প্রতীক হয়েই ফুটে থাকুক— এ আশাবাদ ব্যক্ত করি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন