শনিবার, ১৪ মে, ২০২২

ক্লিনিকগুলোয় ভুল চিকিৎসার অবসান কবে?

দৈনিক চাঁপাই চিত্র, চাঁপাইনবাবগঞ্জ; ১২ অক্টোবর ২০১৫


চিকিৎসা সেবার নামে সারা দেশের আনাচে-কানাচে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে অসংখ্য ক্লিনিক, বিশেষত উপজেলা শহরগুলোয়। সরকারি সব শর্ত পূরণ করে এসব ক্লিনিক চলছে কিনা সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। কেননা এসব ক্লিনিকে রোগীর মৃত্যুর মিছিল যে হারে বাড়ছে, তাতে অবধারিতভাবে সে প্রশ্ন সামনেই চলে আসে। পত্রিকার পাতা উল্টালে প্রতিদিন কোনো না কোনো ক্লিনিকে ভুল চিকিৎসা বা ভুল অপারেশনের শিকার হয়ে রোগীর মৃত্যুর খবর প্রকাশ হচ্ছে। 

গত ৮ অক্টোবর, ২০১৫ তারিখও রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের বেশ কয়েকটি পত্রিকায় নাচোল উপজেলার একটি ক্লিনিকে ভুল অপারেশনের খবর ছাপা হয়েছে। ভুক্তভোগী রোগীর নাম বেবী বেগম (২০)। বাড়ি নওগাঁ জেলার নিয়ামতপুর উপজেলার পাড়ইল ইউনিয়নের শেফায়েতপুর গ্রামে। তার স্বামীর নাম কলিম উদ্দিন। বেবী ভুল চিকিৎসার শিকার হয়ে এখন মরণাপন্ন অবস্থায়। আশার খবর, বেবীর দরিদ্র পিতা আবুল কাশেম ন্যায়বিচারের আশায় নাচোল থানায় লিখিত অভিযোগ করেছেন, যা সচরাচর দরিদ্র পরিবারের কেউ এ সাহস দেখান না। যাহোক, এ বিষয়ে আলোচনা যাওয়ার আগে প্রকাশিত খবরটি দেখে নেয়া যাক। 

প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, গত ২৮ আগস্ট (২০১৫) প্রসব ব্যথা নিয়ে বেবী নাচোল বাসস্ট্যান্ড মোড়ে অবস্থিত জনতা ক্লিনিকে আল্ট্রাসনোগ্রাম করতে যান। সেখানে আল্ট্রাসনোগ্রাম করার পর ক্লিনিক কতৃর্পক্ষ দ্রুত সিজারের জন্য বলে, তা না হলে রোগীর মৃত্যু ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে। কতৃর্পক্ষের এ ধরনের বক্তব্যে রোগীর পরিবার ভীত হয়ে দ্রুত সিজারের অনুমতি দেয়। এরপর বেবীর সিজার করা হয়; কিন্তু সিজারের সময় চিকিৎসকরা ভুলবশত মূত্রনালী কেটে ফেলে দেয়ায় বেবীর প্রসাবের সমস্যা দেখা দেয়। এক সপ্তাহ ক্লিনিকে থাকার পর রোগীকে বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়। বাড়িতে যাবার পর বেবীর প্রচণ্ড ব্লিডিং হলে পুনরায় তাকে জনতা ক্লিনিকে নেয়া হয়। কিন্তু রোগীর অবস্থা বেগতিক দেখে ক্লিনিক কতৃর্পক্ষ নিজ দায়িত্বে বেবীকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়ে আসে এবং পুরো খরচ বহনের প্রতিশ্রম্নতি দেয়। রাজশাহী মেডিকেলে প্রায় এক মাস চিকিৎসাধীন থাকার পরও ক্লিনিক কতৃর্পক্ষ আর কোনো যোগাযোগ করেনি, খরচ বহন তো দূরের কথা। উল্টো বেবীর পিতাকে শাসানো হয়েছে, কাউকে কিছু না বলার জন্য। অথচ দরিদ্র পিতা মেয়ের ভুল চিকিৎসার কারণে প্রায় পুরোপুরি নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। জনতা ক্লিনিকেরও খরচ যেমন তাকে মেটাতে হয়েছে, তেমনি রাজশাহীতেও। মোটা দাগে এই হচ্ছে প্রকাশিত খবরের সারমর্ম। 

কিন্তু প্রকাশিত খবরে ক্লিনিক সম্পর্কে যে তথ্য তুলে ধরা হয়েছে, তা এক কথায় ভয়াবহ ব্যাপার। সে তথ্য পরে তুলে ধরা হচ্ছে। এ কথা নিঃসন্দেহে জোর দিয়েই বলা যায় যে, এসব ক্লিনিকের চিকিৎসা নয়, ব্যবসায় মুখ্য। আর যে বিষয়টি সামনে আসে তাহলো, এরা রোগীদের ভয় দেখিয়ে ফাঁদে ফেলে অপারেশন করে ফেলে মুনাফা কামানোর জন্য। এসব দেখার কেউ নেই। ক্লিনিকগুলো সরকারি শর্ত মেনে চলছে কিনা তা তদারকি করার প্রকৃত দায়িত্ব আসলে কার? আর সিভিল সার্জনের কাজটাইবা কী? তিনি কি এসব দেখতে পান না? পত্রিকাগুলোর সংবাদ কি তার চোখ এড়িয়ে যায়? নাকি দেখেও এড়িয়ে চলেন? এসব প্রশ্ন ওঠা অবশ্যই যুক্তিযুক্ত। দুর্নীতি সব জায়গাতে ছড়িয়ে গেছে। বাদ নেই স্বাস্থ্য খাতও। কিন্তু তাই বলে সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা তো মেনে নেয়ার কোনো বিষয় নয়। গত দেড় বছর যাবৎ নাচোলে স্থায়ীভাবে বসবাস করছি। এই দেড় বছরে অন্তত জনা পাঁচেক গর্ভবতী নারী ক্লিনিকগুলোয় সিজার করতে গিয়ে ভুল চিকিৎসার বলি হয়েছেন। পরে কিছু টাকাপয়সা দিয়ে আপোসরফা হয়ে যাওয়ার খবরও শুনেছি। এই যদি হয় অবস্থা, তাহলে সাধারণ মানুষের ভরসার জায়গাটা থাকলই বা কই? 

সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা না হওয়ার অজুহাতেই মফস্বলে অসংখ্য ক্লিনিক গজিয়ে উঠেছে, যেগুলোর সঙ্গে সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরাই জড়িত। এই অনিয়মটুকু মেনে নিলেও প্রশ্ন থেকে যায়। তাহলো, তারা সঠিক চিকিৎসাটা করতে পারছেন না কেন? সাধারণ মানুষ সুষ্ঠু চিকিৎসা পেলে তাদের ওই অনিয়মটুকু সহজেই মেনে নিত। কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে না। পত্রপত্রিকায় ভুয়া চিকিৎসক ধরা পড়ার খবরও হরহামেশাই ছাপা হয়। তাহলে ভুয়া ক্লিনিকগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান নয় কেন? সাধারণ মানুষের জীবনের কি কোনোই মূল্য নেই? যদি থেকে থাকে তাহলে যেসব ভুয়া ক্লিনিক সারা দেশে গজিয়ে উঠেছে বা উঠছে তা বন্ধে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে তৎপর হতে হবে। এ সেক্টরে আইনের প্রয়োগ সেভাবেই হওয়া উচিৎ, যেখানে কেউ ক্লিনিক দিতে চাইলে যেন হাজারবার ভাবতে বাধ্য হন, তিনি ক্লিনিক দেবেন কিনা।

প্রকাশিত সংবাদে আরো যে তথ্য তুলে ধরা হয়েছে তা হলো, ওই জনতা ক্লিনিকে ২৪ ঘণ্টার জন্য নিয়মিত কোনো চিকিৎসক, ডিপ্লোমা নার্স, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট ও আধুনিক কোনো যন্ত্রপাতি নেই। এছাড়া অপারেশন করার জন্য একজন সার্জন, একজন সহকারী সার্জন, একজন অ্যানেসথেটিকস চিকিৎসক (অজ্ঞান করার জন্য) ও একজন সিনিয়র ডিপ্লোমা নার্স থাকার কথা থাকলেও জেনারেল এমবিবিএস দিয়েই দিনের পর দিন অপারেশন করা হচ্ছে ওই ক্লিনিকে। তবে এ দৃশ্য শুধু ওই ক্লিনিকেরই নয়, আমার মনে হয় উপজেলা শহরের কমবেশ সব ক্লিনিকেই এমনটা হচ্ছে। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, চারটি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত নাচোল উপজেলায় ক্লিনিকের সংখ্যা পাঁচটি। 

তবে যে কথাটি উল্লেখ না করলেই নয়, তাহলো, কোনো ভালো চিকিৎসক বা সার্জারি বিশেষজ্ঞ কি উপজেলার ক্লিনিকগুলোয় সার্বক্ষণিক চাকরি করতে আসবেন? মনে হয়, না। তাহলে যেসব চিকিৎসক এসব ক্লিনিকের সঙ্গে জড়িত তারা কোন ধরনের অপারেশন করার যোগ্য, সে তথ্যও সাধারণ মানুষকে জানানো প্রয়োজন। সংশ্লিষ্ট প্রশাসন পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি ও এসএমএসের মাধ্যমেও এটা করতে পারে। 

চিকিৎসা নিয়ে গাফিলতি অনেক পুরনো খবর। এখন সময় এসেছে এ খাতকে পুনর্জীবিত এবং সাধারণ মানুষের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করার। চিকিৎসা করতে যেয়ে অনেক পরিবার নিঃস্ব হয়েছে, রোগীকেও হারিয়েছে। এরকম অনেক খবর সবার জানা আছে। কাজেই ডিজিটালাইজডের এ সময়ে চিকিৎসা সেবাও ডিজিটালাইজডকরণ দরকার। ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, মফস্বলের বিশেষত উপজেলা পর্যায়ের ক্লিনিকগুলোকে দ্রুত ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরার আওতায় নিয়ে আসা, ক্লিনিকগুলোর স্টাফদের জন্য বাধ্যতামূলক ডিজিটাল আইডেনটিটি কার্ড ইস্যু এবং কার্ড পাঞ্চের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন, যাতে সার্বক্ষণিক চিকিৎসকসহ ক্লিনিক স্টাফদের ক্লিনিকে অবস্থান সম্পর্কে জানা যায়। এক্ষেত্রে ফাঁকি দিলে সিসি ফুটেজের আশ্রয় নেয়া যেতে পারে। এছাড়া কি কি যন্ত্রপাতি আছে এবং কি কি যুক্ত হচ্ছে তা সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কাছে আপডেট করা। প্রতিদিন না হলেও প্রতি সপ্তাহে ক্লিনিকগুলোকে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কাছে রিপোর্ট পেশের উদ্যোগ নিতে হবে। রিপোর্টে কতজন রোগী ভর্তি হয়েছে, কার কোন ধরনের অপারেশন হয়েছে সেসব তথ্য তুলে ধরতে হবে। এবং প্রত্যেক রোগীর জন্য রেকর্ড ফাইল সংরক্ষণ করা বাধ্যতামূলক করতে হবে। ফাইলে ক্লিনিকে চিকিৎসার আগে অন্য কোথায় চিকিৎসা নিয়েছে কিনা সে সম্পর্কিত তথ্যও এবং সব ধরনের প্যাথলজিক্যাল রিপোর্ট থাকতে হবে। এটা না করলে ক্লিনিকগুলোকে বড় অঙ্কের জরিমানার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এছাড়া প্রত্যেক চিকিৎসকের ভিজিটিং কার্ডে সরকারি রেজিস্ট্রেশন নম্বর উল্লেখ করাও বাধ্যতামূলক করতে হবে, যাতে কেউ ইন্টারনেটে গিয়ে ওই নম্বরের ব্যক্তি সম্পর্কে প্রকৃত তথ্য সহজে জানতে পারেন। কোনো ক্লিনিক সরকারি শর্ত পূরণে ব্যর্থ হলে এবং সর্বোপরি ভুল চিকিৎসার কারণে কোনো রোগী মারা গেলে তা তদন্তসাপেক্ষে প্রমাণিত হলে সঙ্গে সঙ্গে ক্লিনিকের লাইসেন্স বাতিল এবং এর মালিকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার বিধানও থাকা জরুরি। 

ভুল চিকিৎসার হার বাংলাদেশে বেড়েই চলেছে। যে কারণে দেশের মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বেশির ভাগ মানুষ ধারদেনা করে হলেও পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে যাচ্ছেন উন্নত চিকিৎসার জন্য। কেন যাচ্ছেন, ওখানকার চিকিৎসা ব্যবস্থাইবা কেমন?— এ বিষয়ে আগামীতে লিখব। আজকের লেখায় সেসব বিষয় টেনে আনলাম না। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন