দৈনিক চাঁপাই চিত্র, চাঁপাইনবাবগঞ্জ; ১৮ জানুয়ারি ২০১৫
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার দৈনিক পত্রিকা চাঁপাই চিত্রের প্রথম পৃষ্ঠায় ১৫ জানুয়ারি ২০১৫, বৃহস্পতিবার একটি প্রতিবেদন বেশ গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হয়েছে। প্রতিবেদনটির শিরোনাম ছিল ‘অবরোধে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ১৮ হাজার শ্রমিক কর্মহীন’। প্রতিবেদনটি ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। যদিও প্রতিবেদনটিরে ভেতর ব্যবহৃত ছবিটি প্রতিবেদনটির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বলে মনে হয়নি। বন্দরে নিষ্ক্রিয় শ্রমিকদের ছবি ছাপা হলে, সেটি ভালো হতো বলেই মনে হয়। যা হোক, আলোচনার বিষয় সেটি নয়। চাঁপাই চিত্রের মাধ্যমে যেটুকু জানতে পেরেছি, তাই-ই যথেষ্ট।
দেশের অস্থির রাজনীতি নিয়ে লেখার উপাদান অনেক। কিন্তু সেসবের সিঁকি ভাগ নিয়েও লেখা হচ্ছে না। ভয়। কেননা কখন কার কোপানলের শিকার হতে হয়, সেটাই সার্বক্ষণিক চিন্তার বিষয়। তাই গা-বাঁচিয়ে লেখার প্রবণতাও ইদানীং দেখা যায়। তারপরও না লিখে তো আর কেউ থাকতে পারে না। যাক সে কথা।
দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম স্থলবন্দর সোনামসজিদ টানা অবরোধের কারণে কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে। ১৪ জানুয়ারির চাঁপাই চিত্রের খবর অনুযায়ী গত শনিবার থেকে নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে আমদানি-রফতানিও বন্ধ করে দিয়েছে ভারতীয় সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টরা। ফলে এ বন্দর দিয়ে বন্ধ রয়েছে পণ্য আমদানি-রফতানি। যদিও রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার যেকোনো মূল্যে সোনামসজিদ স্থলবন্দর সচল রাখার নির্দেশ দিয়েছেন (চাঁপাই চিত্র, ১৭ জানুয়ারি)। আর যেখানে পণ্য আমদানি-রফতানিই হচ্ছে না সেখানে বন্দরের শ্রমিকরা কর্মহীন হয়ে পড়াটাই স্বাভাবিক। আর সাধারণ মানুষের পেটে লাথি পড়া তো নিয়মে পরিণত হয়েছে। যারা অবরোধ ডাকেন (যে কোনো রাজনৈতিক দলই হোক না কেন) তাদের পেটে তো আর লাথি পড়ে না। টান পড়ে না তাদের ডাইনিং টেবিলেও। যত দোষ ওই সাধারণ মানুষের, শ্রমিকের। তাদের জন্মটাই বলি হওয়ার জন্য! পরিত্রাণ নেই, নিরূপায়। পথ চেয়ে ওপরওয়ালাকে গালমন্দ করা ছাড়া আর কোনো গত্যন্তরও থাকে না তাদের সামনে।
শুধু বন্দর শ্রমিকই নন, জেলার পরিবহন ও চালকল শ্রমিকরাও কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। প্রতিবেদন অনুযায়ী, কর্মহীন শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ১৮ হাজার। আর এই ১৮ হাজার শ্রমিক কর্মহীন হওয়ার দরুন ভোগান্তিতে পড়েছেন শ্রমিকের পরিবারপ্রতি গড়ে ৫ জন করে সদস্য হিসাব করা হলে প্রায় লাখখানেক। এর বাইরেও আরো অনেকে আছেন, অবরোধের কারণে যাদের পেটে টান পড়ছে। সে হিসাব বা চিত্রটা প্রতিবেদনে উঠে আসেনি। তবে কর্মহীন হওয়ার চিত্রটা শুধু চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলাতেই নয়, এটি পুরো দেশেই হচ্ছে এবং ভোগান্তিতে পড়া মানুষের সংখ্যা কোটি ছাড়িয়েও যেতে পারে। সাধারণ মানুষের মধ্যে হাহাকার বাড়ছে। আর শাপ-শাপান্ত করছে রাজনৈতিক দলগুলোকে। সরকারও বাদ নেই এ থেকে। এরই মধ্যে ‘অবরুদ্ধ’ খালেদাকে শ্রমিকদের ঘেরাও করার খবরও চোখে পড়েছে।
যদি ধরে নিই দেশের কোটি মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছেন— এ কথা ভাবলেই যে কারোরই গা শিউরে ওঠার কথা। কিন্তু উঠছে না। কেননা প্রত্যেকের মধ্যে এসব বিষয় এখন গা সওয়া হয়ে গেছে। তার জন্য দায়ী সাধারণ মানুষ নয়, দায়ী রাষ্ট্রযন্ত্র এবং রাষ্ট্রের রাজনৈতিক দলগুলো। যারা ক্ষমতার লোভে মোহাচ্ছন্ন। যাদের কাছে সাধারণ মানুষ ঠুঁটো জগন্নাথ ছাড়া কিছুই নয়। যেটুকু সম্মান, শুধু ভোটের সময়। বাকি সময় ডুমুরের ফুল।
হরতাল-অবরোধের কারণে যে পরিমাণ শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়ছেন, এর দায়ভার কে নেবে? অবরোধ আহ্বানকারী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি, না সরকারি দল আওয়ামী লীগ? এ নিয়ে বিস্তর বিতর্ক হতে পারে। একপক্ষ বলবেন, বিএনপির কারণেই জনমনে এ দুর্ভোগ। আরেক পক্ষ বলবেন, সরকারি দলই বিএনপিকে অবরোধ ডাকতে বাধ্য করছে। দুই পক্ষের বক্তব্যই ঠিক— এ নিয়ে কোনো বিতর্কে যাবো না। তবে এর মধ্যেও কথা থেকে যায়। কোনো একটি পরিবারের সন্তান বখে গেলে তার জন্য অভিভাবককেই দায়ী করা হয়। ক্ষেত্রবিশেষে ব্যতিক্রম আছে। সেটা নেহায়েতই কমসংখ্যক ঘটে। মা-বাবার অবহেলা, পারিবারিক অশান্তি, কড়া শাসন প্রভৃতি কারণে সন্তান বখে গিয়ে থাকে। সেজন্য দায়টা তাই মা-বাবার ঘাড়ে গিয়েই বর্তায়। পরিবার থেকে শুরু করে গ্রাম, ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা, বিভাগ, রাজধানী, দেশেরও অভিভাবক থাকে। আর বর্তমানে যেহেতু আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসীন সেহেতু অভিভাবক হিসেবে এর দায়-দায়িত্বের বেশির ভাগটাই তাদের ওপরই বর্তায়। কেননা সরকারের কাছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার যথেষ্ট উপাদান আছে। সেগুলো যথার্থভাবে ব্যবহার করলে এ পরিস্থিতি এড়ানো যেতে পারে। তার জন্য সরকারকেই প্রথমে আন্তরিক হতে হবে।
১৯৯১-৯৬ সময়কালে মাগুরা উপনির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের টানা হরতাল-অবরোধ-অসহযোগের দরুন কী পরিমাণ দুর্ভোগ বেড়েছিল দেশবাসী নিশ্চয়ই তা ভুলে যায়নি। আর যায়নি বলেই টানা ১২ দিনের অবরোধে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড় হয়েছে এবং এরই মধ্যে হা-হুতাশ শুরু হয়ে গেছে। যা কোনোভাবেই বিরোধী দল তথা সরকারি দলের পক্ষে সুসংবাদ বা সুখকর কিছু বয়ে আনবে না। কাজেই সময় থাকতে দুই পক্ষকেই সতর্ক এবং সচেতন হতে হবে। এটা সত্য যে, দেশবাসী এখন হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচির সঙ্গে মোটেই একমত নয়। তার মানে এই নয় যে, বিরোধী দলের প্রতি তাদের সম্মান নেই। আছে। তবে তারা বিকল্প কর্মসূচিই আশা করছে, যাতে সরকার চাপে পড়ে কিন্তু সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ না বাড়ে।
দেশ স্পষ্টতই দুটি শিবিরে অর্থাৎ আওয়ামী লীগ-বিএনপির মধ্যে বিভক্ত। পরিসংখ্যানের হিসাবে দেশের ৭০-৮০ ভাগ মানুষ হয়তো এ দুই দলেই বিভক্ত। বাকি থাকে কমবেশ ২০ ভাগ। ভোটের রাজনীতিতে এই ২০ ভাগই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। কাজেই দেশটাকে যদি দুই দল নিজেদের সম্পদ বলে গণ্য করে তাহলে ভুল করবে। যে ভুলের খেসারত বিএনপি ১৯৯৬ ও ২০০৯ এবং আওয়ামী লীগ ২০০১ সালে দিয়েছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, দেশের বড় দুটি রাজনৈতিক দলকে কখনো ভুল থেকে শিক্ষা নিতে দেখা যায়নি। যে কারণে সংকটের উত্তরণ না হয়ে ঘনীভূত হয়েছে সবসময়।
আর একটি কথা না বললেই নয়। রাজনৈতিক সংকট জিইয়ে রাখার জন্য শুধু নেতাদেরই দায়ী করলে হবে না। দায়ী এ দেশের তথাকথিত কিছু সুবিধাবাদী মানুষ, যারা সংকটকে জিইয়ে রেখে ফায়দা হাসিল করতে চাই। দুই দলেই সচেতন, বিবেকবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের অভাব নেই। অভাব আছে আন্তরিকতার। সেটা কাটিয়ে উঠে দুই দলই দেশকে শান্তিময় করে তুলবে, সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে— কায়মনোবাক্যে সবারই প্রত্যাশা তাই।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন