শনিবার, ১৪ মে, ২০২২

মোটরসাইকেল রেজিস্ট্রেশন ও ড্রাইভিং লাইসেন্স : উদ্বুদ্ধকরণে প্রয়োজন পদ্ধতির সহজীকরণ

দৈনিক চাঁপাই চিত্র, চাঁপাইনবাবগঞ্জ; ০১ আগস্ট ২০১৫


চলতি বছরের মে মাসের শেষের দিকে পুলিশের আইজি মহোদয় সড়কে নম্বরবিহীন মোটরসাইকেল ধরপাকড়ে অভিযান চালানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন। সে মোতাবেক সারা দেশে এখন ব্যাপক হারে অভিযান চলছে নম্বরবিহীন মোটরসাইকেল ধরপাকড়ে। থানাগুলোতেও টার্গেট দেয়া হচ্ছে নম্বরবিহীনদের ধরতে। থানায় প্রবেশ করলেই চোখে পড়বে শতাধিক নম্বরবিহীন মোটরসাইকেল। সে সঙ্গে মোটরসাইকেল মালিকদের গাড়ি ছাড়িয়ে নেয়ার জন্য আনাগোনা। যদিও কোনো তদবিরে এখন আর কাজ হচ্ছে না। রেজিস্ট্রেশনের জন্য ব্যাংকে জমাকৃত টাকার মানি রিসিপ্ট না দেখাতে পারলে পার পাওয়ার কোনো সুযোগই নেই বা থাকছে না। অফিসার ইনচার্জদের (ওসি) একটাই কথা, ‘পুলিশ সুপার স্যারকে বলুন।’

 

অভিযানের আওতা থেকে বাদ নেই চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলাও। প্রতিদিনই জেলার পাঁচটি উপজেলার বিভিন্ন পয়েন্টে চলছে নম্বরবিহীন মোটরসাইকেল ধরার অভিযান। এর জেরে সড়কে নম্বরবিহীন মোটরসাইকেল চলাচলও কমে গেছে। ভয়ে কেউ সড়কে মোটরসাইকেল বের করতে সাহস পাচ্ছে না। জানা গেছে, অভিযানে পুলিশ-সাংবাদিক কেউ-ই ছাড় পাচ্ছেন না। আর তাই বর্তমানে মোটরসাইকেল ধরপাকড় নিয়ে আলোচনা টক অব দ্য টাউনে পরিণতে হয়েছে।

অভিযানের জন্য সাধুবাদ। তবে মোটরসাইকেলের রেজিস্ট্রেশন কিংবা ড্রাইভিং লাইসেন্স সহজীকরণের জন্য কতৃর্পক্ষেরও পদক্ষেপ নেয়ার প্রয়োজন রয়েছে। সড়কে নম্বরবিহীন মোটরসাইকেল চলাচল করুক— সচেতন ব্যক্তিমাত্রই তা আশা করেন না। কিন্তু এ দেশে এ দুটি কাজ করতে গেলে অধিকাংশ সময়ই হয়রানি হতে হয়। যে কারণে রেজিস্ট্রেশন কিংবা ড্রাইভিং লাইসেন্স করতে বেশির ভাগেরই অনীহা প্রকাশ পায়। অথচ মোটরসাইকেল রেজিস্ট্রেশন যদি শোরুম থেকে প্রদানের ব্যবস্থা থাকত অর্থাৎ কেনা মাত্রই রেজিস্ট্রেশন পেয়ে যেত তাহলে আজকে নম্বরবিহীন মোটরসাইকেল ধরতে যে অভিযান, তার প্রাসঙ্গিকতা অনেকাংশেই ম্লান হয়ে যেত। কিন্তু তা না হয়ে এই ডিজিটাল যুগেও মোটরসাইকেলের রেজিস্ট্রেশন করতে সাধারণ মানুষের বিরক্তিই প্রকাশ পায়। কেন মানুষের অনীহা?— বিষয়টিকে গভীরভাবে অনুধাবন করে বিআরটিএ কতৃর্পক্ষ তথা সরকার আগামীতে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেবে। তবে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, শোরুম থেকে রেজিস্ট্রেশন নম্বর প্রদানই সবচেয়ে সহজ পন্থা। এতে একদিকে যেমন আলাদাভাবে রেজিস্ট্রেশন করার হয়রানি থেকে সাধারণ মানুষ মুক্ত হবে অন্যদিকে মোটরসাইকেল কিনতে হলে যে কাউকে রেজিস্ট্রেশনসহই কিনতে হবে। আশা রাখব, বিআরটিএ কতৃর্পক্ষ এ বিষয়টি ভেবে দেখবেন এবং তড়িৎ ব্যবস্থা নেবেন। 

রেজিস্ট্রেশন করতে অনীহার আরো একটি কারণ হলো রেজিস্ট্রেশন ফির হার অনেক বেশি। একদিকে এ দেশে যেমন মোটরসাইকেলের দামও অনেক বেশি, তেমনি রেজিস্ট্রেশনও খরচও। খরচ যদি ১০ হাজার টাকার নিচে থাকত তবে মোটরসাইকেল রেজিস্ট্রেশন করার হার অনেকাংশে বেড়ে যেত। সত্যি বলতে কি, মোটরসাইকেল মালিকরা প্রতি বছরই বাজেটের দিকে চেয়ে থাকেন, এবার বোধহয় রেজিস্ট্রেশনের হার কমবে— এ আশায়। কিন্তু আশায় গুঁড়ে বালি। দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়; কিন্তু রেজিস্ট্রেশন ফির হার কমে না। এ প্রসঙ্গে একটি চলমান বাস্তবতার উল্লেখ করা প্রয়োজন। এ দেশে ১৫০ সিসি মোটরসাইকেল রেজিস্ট্রেশন করতে যে পরিমাণ খরচ হয় তার সঙ্গে আরো ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা যোগ করলে পাশের দেশ ভারতে একটি স্কুটি মোটরসাইকেল কেনা যায়। কাজেই প্রয়োজনের জায়গা থেকে সাধারণ মানুষ মোটরসাইকেল কিনে ফেলেন ঠিকই, কিন্তু এসব কারণে রেজিস্ট্রেশন করা থেকে বিরত থেকে যান অনেকেই। আরেকটি বিষয়, এ বাহনটি নিম্ন মধ্যবিত্তের প্রয়োজনীয় হলেও এটির দামই বাড়তে থাকে প্রায় বছরই। এবারের বাজেটেও তাই হয়েছে। সরকার এসব বিষয় বিবেচনায় নেবে— এমনটাই মত অনেকের। 

এবার আসছি ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রসঙ্গে। মোটরসাইকেল রেজিস্ট্রেশন করতে যতটা না ভোগান্তি তার চেয়ে বেশি ড্রাইভিং লাইসেন্সে। এখানে দিনের পর দিন জেলা সদরে বিআরটিএ অফিসে ধরনা দিতে হয়। পরীক্ষার তারিখ নেয়ার জন্য। যা জেলার সদর উপজেলা বাদে অন্য ৪টি উপজেলার সাধারণ মানুষের কাছে কঠিন হয়ে পড়ে। অথচ বিষয়টির সহজীকরণ সামান্য ব্যাপারই বটে। কিন্তু সেদিকে কোনো নজর নেই। আবার মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেলে নবায়নের জন্য আরেক জটিলতা। বলা হয় দুদিন পরে যাওয়ার জন্য। কিন্তু সড়কে কর্তব্যরত পুলিশের কর্তাব্যক্তিরা তা মানবেন না। তাদের চায় ডকুমেন্টস। মুখের কথায় কাজ হবে না। এই যে দুদিন পর যেতে বলা এ সময়ে মোটরসাইকেল মালিক যদি ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য শাস্তি বা জরিমানার সম্মুখীন হন তাহলে এর দায়ভার কার? এ প্রশ্ন তোলাটা নিশ্চয়ই অবাঞ্ছনীয় হবে না। 

একজন মোটরসাইকেল চালকের প্রথম কাজ হলো বিআরটিএ থেকে শিক্ষানবীশ ড্রাইভিং লাইসেন্স নেয়া। তারপর ইস্যুর ২ মাসের মধ্যে পরীক্ষার তারিখ নেয়া এবং পরীক্ষায় বসা। পরীক্ষা বলতে লিখিত ও মৌখিক। তারপর ফিল্ড টেস্ট। এরপর মূল লাইসেন্স প্রাপ্তি। বলতে গেলে দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। তবুও ঠিক আছে বলে মেনে নেয়া যায়। কিন্তু সমস্যা হলো অন্যত্র। এই যে শিক্ষানবীশ ড্রাইভিং লাইসেন্স ইস্যুর পর পরীক্ষার তারিখ নেয়া, তার জন্য চালককে প্রতি মাসের ১০-১৫ তারিখের পর প্রতিদিন খোঁজ নিতে হবে বিআরটিএ অফিসে। এ জটিলতা কি এড়ানো যায় না? অবশ্যই যায়। শিক্ষানবীশ লাইসেন্স ইস্যুর পর বিআরটিএ কতৃর্পক্ষের উচিত সব শিক্ষানবীশদের সেলফোনে মেসেজের মাধ্যমে পরীক্ষার তারিখ জানিয়ে দেয়া। তাদের কাছে গিয়ে পরীক্ষার তারিখ নিতে হবে কেন? যখন কেউ শিক্ষানবীশ লাইসেন্স করলেন, তার অর্থ দাঁড়াল তিনি পরীক্ষায় বসতে চান। আর এ বসার আয়োজন তো বিআরটিএ কতৃর্পক্ষকেই করতে হবে। কবে, কখন পরীক্ষা হবে তার বিস্তারিত তারাই জানাবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো তা করা হয় না। এখানে চালককেই খোঁজ রাখতে হয় বা হচ্ছে। যা একজন সাধারণ মানুষের পক্ষে সবসময় পেরে ওঠা সম্ভবপর হয় না। বর্তমানে শিক্ষানবীশ লাইসেন্সের মেয়াদ তিন মাস। এই তিন মাসের মধ্যে একজন শিক্ষানবীশ চালককে তিনবার পরীক্ষার তারিখ জানিয়ে পরীক্ষায় বসানো দরকার। যদি কেউ পরপর তিনবার পরীক্ষায় না বসে তারজন্য জরিমানা ধার্য করা যেতে পারে। কিন্তু তার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন পদ্ধতির সহজীকরণ। তাছাড়া কেউই জরিমানা গুনতে রাজি হবেন বলে মনে হয় না। 

কাজেই শুধু অভিযান চালালেই হবে না। সাধারণ মানুষ যাতে মোটরসাইকেল রেজিস্ট্রেশন কিংবা ড্রাইভিং লাইসেন্স করতে উদ্বুদ্ধ হয়, সচেতন হয় তার জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে এবং তা হতে হবে সহজীকরণ; যাতে সহজেই মানুষ এসব পেতে পারে। তা না হলে অভিযান মাসের ৩০ দিনই অব্যাহত রাখতে হবে। সেটি সম্ভব হবে কিনা তা পুলিশ কতৃর্পক্ষই ভালো বলতে পারবেন। তবে এসব নিয়ে ভাবার সময় নিশ্চয়ই হয়েছে এবং তার জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেবারও সময় হয়েছে তা জোর দিয়েই বলা যায়। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন