দৈনিক চাঁপাই চিত্র, চাঁপাইনবাবগঞ্জ; ১৮ জানুয়ারি ২০১৬
সরোজ গুপ্ত ক্যানসার সেন্টারে যথারীতি ফরম পূরণ করি। এরপর যাই অন্য একটি কাউন্টারে। সেখানে দেয়া হয় লাল কার্ড। তারপর আরেক কাউন্টারে লাল কার্ড জমা দিয়ে চিকিৎসক দেখানোর ‘রেজিস্ট্রেশন ফি কুপন’ সংগ্রহ করি। এ জন্য খরচ হয় ২০০ রুপি (বলা ভালো, বর্তমানে এ ফিসহ আরো অন্যান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফি বেড়েছে সরোজ গুপ্ত ক্যানসার সেন্টারে)। ক্যানসার সেন্টারটিতে দুই ধরনের কার্ড দেয়া হয়— লাল ও সবুজ। লাল কার্ড ক্যানসার পেশেন্টদের জন্য সংরক্ষিত। যাহোক। কুপনেই উল্লেখ করে দেয়া হয়, কত নম্বর কক্ষের সামনে অপেক্ষা করতে হবে। ক্যানসার সেন্টারের যেখানটায় সাধারণত রোগী দেখা হয়, সেটার নাম ‘আউট পেশেন্ট ডিপার্টমেন্ট’। সংক্ষেপে ওপিডি। ওপিডিতে গিয়ে নির্ধারিত কক্ষের সামনে অপেক্ষা করতে থাকলাম। বোন মার্জিয়া সুলতানা এবং আমার মনে তখন দুশ্চিন্তাই ঝড় বয়ে যাচ্ছিল এ আশঙ্কায়— চিকিৎসক কী বলে তার জন্য!
একসময় ডাক পড়ল আমাদের। দুরু দুরু বুকে প্রবেশ করি চিকিৎসকের কক্ষে। বেশ বড় কক্ষ। একপাশে পর্দা দেয়া দুটো কেবিন টাইপের— রোগীদের শোয়ানোর জন্য। এক কক্ষেই সিনিয়র-জুনিয়র সমন্বয়ে পাঁচ-ছয়জন চিকিৎসক। কোনো সমস্যা দেখা দিলে দ্রুতই পরামর্শ করে নিচ্ছেন একে অন্যের সঙ্গে। তবে সমস্যা হলো, কোনো চিকিৎসকের পরিচয়, পদবি কিংবা তার ডিগ্রি জানার সুযোগ নেই। এ সম্পর্কিত কোনো ডিসপ্লেও চোখে পড়েনি।
কক্ষ সহকারীর দেখিয়ে দেয়া চিকিৎসককে মায়ের বাংলাদেশী চিকিৎসকের কাগজপত্র দেখালাম। তিনি মনোযোগ সহকারে সব কাগজ দেখলেন। তারপর জানতে চাইলেন, হিন্দি বুঝি কিনা? চিকিৎসক ভদ্রলোক নন-বেঙ্গলি ছিলেন। ‘বুঝি’ বলাতে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এফএনএসির স্লাইড নিয়ে এসেছি কিনা। ‘না’ বলাতে তিনি জানালেন, কিছু টেস্ট আছে এগুলো করতে হবে। পাশাপাশি এফএনএসি আবার করতে হবে। লাল কার্ডে যাবতীয় বিবরণ লিখে টেস্ট-সংবলিত হলুদ কাগজের একটি ‘অ্যাডভাইস মেমো’ দিলেন।
চিকিৎসকদের ব্যবহার মুগ্ধ হলাম। যে চিকিৎসক মাকে দেখছিলেন, তিনি ‘মা’ ছাড়া কথা বলেননি। বেশ আন্তরিক এবং হৃদ্যতার সঙ্গে মায়ের সব সমস্যা জানার চেষ্টা করছিলেন। আরেকটি বিষয়, বাংলাদেশে বেসরকরি হাসপাতালে একসঙ্গে পাঁচ-ছয়জন চিকিৎসক একই কক্ষে বসে রোগী দেখছেন কিনা তা আমার জানা নেই। এ দৃশ্য যেমন ক্যানসার সেন্টারে দেখেছি, তেমনি দেখেছি মুম্বাইয়ের টাটা মেমোরিয়াল সেন্টারেও (টাটা সম্পর্কে অন্য পর্বে আলোচনা করা হবে)।
কালক্ষেপণ না করে দ্রুত সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য দৌড় শুরু করি। অবস্থাটা এমনই যে, তখন অন্য কোনো চিন্তা করার সুযোগ ছিল না। সব টেস্ট করানোর পর আবার অপেক্ষা। কেননা, ক্যানসার সেন্টারটিতে বেঁধে দেয়া তারিখের আগে রোগী দেখার নিয়ম নেই। সেই নিয়মের বলি হয়ে কয়েকদিন অপেক্ষা করতে হলো। ২০১৪ সালের ৫ নভেম্বর সমস্ত রিপোর্ট নিয়ে যাই চিকিৎসকের কাছে। উল্লেখ্য, ওই হাসপাতালে যতবার চিকিৎসক দেখানো হোক না কেন প্রতিবারই নির্ধারিত কাউন্টারে লাল কার্ড জমা দিয়ে ‘ফ্রি ফলোআপ কুপন’ সংগ্রহ করতে হয়। বলা ভালো, লাল কার্ড এই কারণে জমা দিতে হয় যে, ভর্তির শুরুর দিন থেকে রোগীর নামে একটি রেকর্ড ফাইল তৈরি হয় এবং লালকার্ডটি জমা দিলে রেজিস্ট্রেশন নম্বর অনুযায়ী আর্কাইভে থাকা ফাইলটি খুঁজে বের করে নির্ধারিত রুমে পাঠিয়ে দেয়া হয়। রোগীর কাছ থেকে কোনো কাগজপত্র দেখতে চাওয়া হয় না। শুধু বাইরে কোনো পরীক্ষা করলে তা দেখাতে হয়। পদ্ধতিটি ভালো এবং ঢাকার মিরপুরে অবস্থিত একটি হাসপাতালেও এই পদ্ধতিটি দেখেছি।
পরীক্ষা-নিরীক্ষার সব কাগজপত্র দেখে চিকিৎসক জানালেন, ব্রেস্ট ক্যানসার। তবে ঘাবড়াবোর কিছু নেই। একদম নরমাল স্টেজে। আমাদের সৌভাগ্য যে, আমরা যে চিকিৎসককে পেয়েছিলাম তিনি বয়সে নবীন হলেও ব্রেস্ট ক্যানসার স্পেশালিস্ট হয়ে উঠেছিলেন। তিনি মাকে বললেন, ‘মা, ভয়ের কিছু নেই। সামান্য একটা দানার মতো অবস্থায় আছে। অপারেশন করলেই সেরে যাবে।’ এরপর অপেক্ষা করতে বললেন। কেননা বোর্ড বসবে, তারপর সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবে। এই সেন্টারে জটিল রোগের ক্ষেত্রে বোর্ড বসে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। যদি ওই সেন্টারে চিকিৎসা সম্ভব হয়, সেটা জানাবে। না হয় ছেড়ে দেবে। আরো জানানো হয়, রোগীর অবস্থা কোন পর্যায়ে এবং অপারেশন করলে কতটুকু উন্নত হওয়ার সুযোগ আছে বা নেই। যদি কোনো রোগীর উন্নত হওয়ার সুযোগ কম থাকে সেক্ষেত্রে তারা বাড়ি নিয়ে যাওয়ার পরামর্শই দেয়। আর বাংলাদেশে যখন কিছুই করার থাকে না, তখন ঘোষণা দেয়া হয়। তবে এটাও ধীরে ধীরে পরিবর্তন হচ্ছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে।
অপেক্ষা করার পর বেলা দুটোর পর আবার আমাদের ডাক পড়ল বোর্ডের সামনে। বোর্ড সিদ্ধান্ত দিল অপারেশনের। আমরা প্রস্তুত জেনে প্রথমে অ্যানেসথেটিকস চেকআপের জন্য পাঠালেন। মায়ের প্রেসার উচ্চ হয়ে যাওয়ায় চারদিন অপেক্ষা করতে হয়েছিল, তা নিয়ন্ত্রণের জন্য। এরপর সরাসরি ভর্তি করি, অপারেশনের জন্য। কিন্তু হাসপাতালের অভ্যন্তরীণ সমস্যার কারণে আমাদের পরবর্তী তারিখ দেয় ২২ নভেম্বর। ভর্তি করানো হয়েছে, রোগী হয়রানি হচ্ছে— এ কথা ভেবেই নির্ধারিত চিকিৎসক মায়ের কেবিনে ছুটে গিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করেন, অপারেশনটা করতে পারছেন না বলে। চিকিৎসকের এ আচরণে আরো অভিভূত হলাম। এ দৃশ্য দেশে কল্পনা করা যায় না, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে।
মায়ের অপারেশন ২২ নভেম্বর হয়েছিল। অপারেশন করার জন্য আমি ছাড়া আর কাউকে সঙ্গে নিইনি। কেননা, প্রথমত হাসপাতালে রোগীর সঙ্গে কারো থাকার নিয়ম নেই। দ্বিতীয়ত ওয়ার্ডের নার্স, আয়ারা যে পরিমাণ আন্তরিক তাতে কাউকে নেয়ার চিন্তাও করিনি। আর ছোট বোনও হাসপাতালের পরিবেশ দেখে অপারেশনের সময় যাওয়ার জন্য তাগিদ অনুভব করেনি। ওই ক্যানসার সেন্টারে অপারেশনের পর মায়ের কেমো ও রেডিওথেরাপি দিয়েছি। চিকিৎসা এখনো চলছে। রুটিন চেকআপের জন্য তিন মাস পর পর যেতে হচ্ছে। সত্যিকার অর্থে, ক্যানসারের চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদি। এখানে ধৈর্য হারালে চলবে না।
এই পর্যন্ত ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ। আর দীর্ঘায়িত করতেও চাই না। কেননা তার জন্য বিস্তৃত পরিসর দরকার। সেটা সম্ভবও নয়। কলকাতায় মায়ের চিকিৎসা করতে যাওয়া-আসায় যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়েছে তা এখন পাঠকের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই।
ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়েছে, ইন্ডিয়া চিকিৎসা করতে যাওয়ার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ বিদ্যমান। প্রথমত, উন্নত চিকিৎসা ও চিকিৎসক তথা প্রতিষ্ঠানের আচরণ; দ্বিতীয়ত, কিছুটা হলেও খরচের স্বল্পতা; তৃতীয়ত, থাকার সুবিধা এবং চতুর্থত, বিশ্বাস। বিশ্বাস এই কারণে যে, প্রত্যেকেই ভাবছেন ইন্ডিয়ায় গেলে ভালো ও উন্নত চিকিৎসা পাবেন। তাছাড়া বাংলাদেশে ভুল চিকিৎসার হার যেভাবে বেড়ে চলেছে, তাতে বিশ্বাস এবং আর্থিক সঙ্গতির জায়গা থেকে বেশিরভাগই পাড়ি দিচ্ছেন ইন্ডিয়াতে। আর যে কথাটি না বললেই নয়, তাহলো আমরা বাদে আর যেসব বাংলাদেশীকে সেখানে দেখেছি তাদের বেশির ভাগই ছিলেন এ দেশে ভুল চিকিৎসার শিকার। সেখানে যাওয়া অন্য বাংলাদেশীদের কথা বলেই তা জানা গেছে।
বাংলাদেশেও যে চিকিৎসা হয় না, তা বলা যাবে না। তবে ঢাকার যে কটি হাসপাতালের নামডাক হয়েছে তাদের চিকিৎসা খরচও বেশ ব্যয়বহুল। অন্তত যারা চিকিৎসা করিয়েছেন সেসব হাসপাতালে, তাদের কাছ থেকেই এ তথ্য জানা গেছে। সে জায়গা থেকে কলকাতা কিংবা ভেলোরে চিকিৎসা বাংলাদেশের তুলনায় খরচ কম তা বলা যায়।
কলকাতার মধ্যে ২০০ রুপিতে চার-পাঁচজন একসঙ্গে এক কক্ষে প্রতিদিন যেভাবে পার করা যায় তা ঢাকাতেও সম্ভব নয়। ক্যানসার সেন্টারের আশপাশে যেসব খাবার হোটেলগুলো আছে তাতে খাবারও তুলনামূলক সস্তা। আবার দীর্ঘদিন থাকতে হলে গেস্ট হাউস বা আবাসিক হোটেলগুলোতে আচ্ছে রান্না করে খাবার সুযোগ। আশপাশে বাসা বা একটি ঘরও এক মাসের জন্য ভাড়া পাওয়া যায়। যা ঢাকাতে সম্ভব নয়। তবে শুনেছি সিরাজগঞ্জের একটি হাসপাতালের পাশে এ ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে। আর আমাদের দেশে সবারই যে ঢাকাতে থাকার সুযোগ-সুবিধা আছে, এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই।
খরচের স্বল্পতা বলছি এই কারণে যে, প্রথম দফায় ভর্তি হয়ে চিকিৎসক দেখানো, বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা; দ্বিতীয় দফায় অপারেশন এবং তৃতীয় দফায় একটি কেমোথেরাপি নেয়া ও দুটি কেমোথেরোপির সম্পূর্ণ মেডিসিনি নিয়ে আসা এই মিলিয়ে সরোজ গুপ্ত ক্যানসার সেন্টারে আমাদের খরচ হয়েছে বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ১ লাখ। এর বাইরে থাকা ও খাওয়া খরচ রয়েছে। বলা প্রয়োজন, প্রথম কেমো ক্যানসার সেন্টারে দিয়েছিলাম। পরের কেমো দুটি সেখানকার চিকিৎসকের পরামর্শ সাপেক্ষেই দেশে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে দিয়েছিলাম। সেখানে শুধু কেমো পুশ করতে দুই দফায় খরচ হয়েছে প্রায় ১২ হাজার টাকা। অথচ কেমো দুটি কিনতে বাংলাদেশী টাকায় খরচ হয়েছে প্রায় ৫ হাজার।
এখানে আরেকটি কথা উল্লেখ করা দরকার। ঢাকায় যে হাসপাতালে কেমো পুশ করা হয়েছিল তা নামকরা একটি প্রতিষ্ঠান। তবে যে ওয়ার্ডে কেমোথেরাপি দেয়া হয়েছিল তা দেখে অবাক হতে হয়েছে। কেননা কলকাতার ক্যানসার সেন্টারে কেমো ইউনিটে রোগীর সঙ্গে কেউ থাকতে পারেন না। আর ঢাকার হাসপাতালটিতে বেডের ঠাঁসাঠাসি তো আছেই, পাশাপাশি রোগীর পাশে স্বজনদের ভিড়। বোঝার উপায় নেই যে, এটি শুধু কেমোথেরাপি দেয়ার ওয়ার্ড। তাছাড়া কেমো ইউনিটে জুনিয়র চিকিৎসকদের ছাড়া সিনিয়রদের দেখা যায়নি। আর ক্যানসার সেন্টারে সিনিয়র-জুনিয়র সার্বক্ষণিক থাকেন কেমো ইউনিটে।
ঢাকার ওই হাসপাতালে মায়ের যে বেড নির্ধারিত হয়েছিল, সেটি ছিল একেবারে টয়োলেট ঘেঁষা। দুর্গন্ধে থাকাও দায় ছিল। কর্তব্যরত নার্সকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেমো ইউনিট এরকম কেন? এটি তো সংরক্ষিত হওয়া উচিত পাওয়ারফুল মেডিসিনের কারণে? নার্স কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি। জানিয়েছিলেন, এ পরিবেশ তারও পছন্দ নয়। কিন্তু তাদের কিছু করার নেই। চট্টগ্রামের অধিবাসী ওই নার্স আরো জানিয়েছিলেন, তার মা-বাবার চিকিৎসাও ইন্ডিয়ায় করিয়েছেন, দেশে আস্থা না থাকার কারণে।
(বাকি অংশ আগামী সোমবার)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন