শনিবার, ১৪ মে, ২০২২

দুই শিক্ষক মহারথীর সঙ্গে একদিন...

দৈনিক চাঁপাই চিত্র, চাঁপাইনবাবগঞ্জ; ১৮ অক্টোবর ২০১৫


১৩ অক্টোবর, ২০১৫। দিনটি ছিল সংগ্রামী কৃষক নেতা, বাঙালি মহীয়সী নারী ও নাচোলের তেভাগা আন্দোলনের অন্যতম নেতা রানীমা ইলা মিত্রের ১৩তম মৃত্যুবার্ষিকী। এ দিনটিতে সৌভাগ্য হয়েছিল দুই শিক্ষক মহারথীর সঙ্গে দিনের পুরোটা ভাগ সময় কাটানোর। দুই শিক্ষক মহারথী আর কেউ নন, তারা হলেন— বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমানে চাঁপাইনবাবগঞ্জ এঙ্মি ব্যাংক কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. আবদুল মান্নান আকন্দ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক ও আরডিসির চেয়ারপারসন গবেষক বর্তমানে টকশোখ্যাত পণ্ডিতমানুষ প্রফেসর মেসবাহ কামাল স্যার। তাদের সান্নিধ্যে থেকে নাচোল নিয়ে তাদের গর্ব, তাদের অহঙ্কার আর স্বপ্নের কথা জানতে পেরে যারপরনাই আবেগে আপ্লুত হয়েছি। এও সত্য যে, কিছুটা লজ্জিত হয়েছি। সে ব্যাখ্যা পরে। 

রানীমা ইলা মিত্রের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে নাচোলের তেভাগা আন্দোলনের সূতিকাগার কেন্দুয়া পঞ্চানন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে রানী ইলা মিত্র চত্বরে দুপুরে আয়োজন করা হয় আলোচনা সভার। রানী ইলা মিত্র সংসদ আয়োজিত এ আলোচনা সভা অনুষ্ঠানে সহযোগিতা করেছে গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠান রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট কালেকটিভ-আরডিসি। আগের দিনই দাওয়াত পেয়েছিলাম। মনস্থিরও করেছিলাম যাওয়ার। 

১৩ অক্টোবর সকাল ১০টার দিকে প্রথমে যাই আরডিসির নাচোল অফিসে, সঙ্গী নাচোল প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম বাবু। সেখানে গিয়ে দেখি স্যারদের সঙ্গে আলোচনায় মত্ত নাচোল উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান সজ্জন ব্যক্তি মজিবুর রহমান, এঙ্মি ব্যাংক কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ড. আরিফুল ইসলাম, আরডিসির সাধারণ সম্পাদক জান্নাত-এ-ফেরদৌসী ও প্রোগ্রাম ম্যানেজার ড. ফারহানা ইয়াসমিন। তাদের সঙ্গে যুক্ত হই আমরা। এরপর আসেন নাচোল মহিলা ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ ওবাইদুর রহমান। প্রায় ঘণ্টাখানেক প্রাণবন্ত আড্ডা। জ্ঞানগর্ভ আড্ডার আলোচনা বলে শেষ করা যাবে না। শুধু এটুকুই বলব, মেসবাহ কামাল স্যার অনেক দিন ধরেই নাচোল আসছেন, কিন্তু আবদুল মান্নান আকন্দ স্যার নতুন। তিনি নাচোল এসে গর্ব অনুভব করছেন— এটুকু নিদ্বির্ধায় জানাতে কোনো কার্পণ্য করলেন না। 


স্যাররা বললেন, তারা একটু ইলা মিত্র গণপাঠাগারটা দেখতে যেতে চান। দেরি না করে বেরিয়ে পড়ি। পাঠাগার পরিদর্শন শেষে নাচোল ডিগ্রি কলেজের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক ইসলাম উদ্দিন স্যারের নাচোল কলেজে পদধূলি দেয়ার জন্য দুই মহারথী শিক্ষকের প্রতি আবেদনে সাড়া না দিয়ে পারলেন না আবদুল মান্নান আকন্দ ও মেসবাহ কামাল স্যার। এবার সঙ্গী হলেন নাচোল ডিগ্রি কলেজের বাংলা বিভাগের শিক্ষক আল্লামা আকবর ও নাচোল প্রেস ক্লাবের সভাপতি অলিউল হক ডলার। 

দুই শিক্ষক মহারথীর পদধূলিতে আপ্লুত হলেন নাচোল কলেজের শিক্ষকমণ্ডলী। তারা টকশোখ্যাত মেসবাহ কামাল স্যারের কাছ থেকে আরো বেশি সময় চাচ্ছিলেন। কিন্তু কেন্দুয়ায় মূল অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার কারণে তাদের পক্ষে বেশি সময় দেয়া সম্ভবপর হয়নি। পরবর্তীতে আবার যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বের হওয়া। 

এবার আবদারের পালা নাচোল মহিলা ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ ওবাইদুর রহমানের। স্যারদের প্রতি তারও বিনীত অনুরোধ, কলেজে পদধূলি দেয়ার জন্য। অগত্য কি আর করা! স্যাররাও না করতে পারলেন না। যাওয়া হলো মহিলা কলেজে। সেখানে কিছুটা সময় পার করার পর মনে হলো, মেসবাহ কামাল স্যার শিক্ষক হিসেবে নয়, টকশোর বক্তা হিসেবেই বেশি পরিচিত হয়ে উঠেছেন। বর্তমানে স্যারের যে অবস্থান, তাতে এটাই স্বাভাবিক।

আর দেরি নয়, এবার কেন্দুয়ার উদ্দেশ্যে রওনা। কেন্দুয়ায় যখন পেঁৗছলাম তখন ঘড়ির কাঁটা বেলা ১টা ছুঁই ছুঁই করছে। ওই ভরদপুরেও মঞ্চের সামনে আদিবাসী ও স্থানীয় অন্যান্য অধিবাসীদের দেখে ভালোই লাগল। মানুষ সচেতন হয়েছে, মানুষ এখন মানুষের কর্মকে মূল্যায়ন করতে শিখেছে, মানুষ তেভাগা তথা ইলা মিত্রকে বুঝতে শিখেছে। এটাই তো আনন্দের, গর্বের। নিজেই নিজের কাছে গর্ব অনুভব করলাম এই ভেবে যে, যে কাজ আমরা ১৯৯৩ সালে শুরু করেছিলাম, তা এখনো চলছে এবং এ নিয়ে বেশ কাজও হয়েছে। সাফল্যটা বোধহয় এখানেই! আর ইলা মিত্রকে কেন্দ্র করেই বর্তমানে নাচোলের উন্নয়ন, এ সত্যকে অস্বীকার করার উপায় নেই। আর এজন্য দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সাধুবাদ জানাই। তার আন্তরিকতায় এসব সম্ভব হয়েছে বা হচ্ছে। 

কেন্দুয়ায় যোগ দিলেন প্রথম আলোর চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি আনোয়ার হোসেন দিলু ভাই ও ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন চ্যানেলের ফয়সাল মাহমুদ। তবে দিলু ভাই সম্পর্কে একটা সত্য স্বীকারোক্তি না করলে দোষই হবে। তা হলো, তিনি যেন আদিবাসীদের অন্তরাত্মা হয়ে উঠেছেন। নিজ জেলা বাদেও নওগাঁ, রাজশাহীতে আদিবাসীদের কোনো অনুষ্ঠানে তিনি যাননি, এমনটা বোধহয় খুব কমই ঘটেছে। অন্তত প্রথম আলোতে প্রকাশিত তার রিপোর্ট সেই সাক্ষ্যই দেয়। আদর্শিক জায়গা থেকে এসব মানুষের প্রতি স্যালুট জানাতেই হয়। স্যালুট দিলু ভাই। 

অনুষ্ঠানের শুরুতে আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী নাচ ও গানের তালে তালে অতিথিদের মালা দিয়ে বরণ করে নেয়া হয়। বক্তব্য দেয়ার খুব একটা সময় ছিলও না। সংক্ষেপে সবাই তাদের বক্তব্য পেশ করলেন। আর ড. ফারহানা তো আদিবাসীদের সঙ্গে মিশে গেলেন। অর্থাৎ মঞ্চের সামনে আদিবাসীদের সঙ্গে মাটিতে বসে বক্তব্যের পুরো সময়টা পার করলেন। তার এ আন্তরিকতায় অভিভূত হয়ে নাচোল উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) সরকার অসীম কুমারের উদ্যোগে তাকে মালা পরিয়ে সম্মাননা জানান আবদুল মান্নান আকন্দ স্যার। সরকার অসীম কুমার, একজন মানুষও বটে! একজন প্রথম শ্রেণীর সরকারি কর্মকর্তা হয়েও তিনি যেভাবে পুরো অনুষ্ঠানের তদারকি করেছেন, তা সচরাচর হয় না। যার প্রাপ্য তিনি অনুষ্ঠান মঞ্চেও পেলেন। কেন্দুয়ার স্থানীয়রা একবাক্যে তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। বেশি অবাক হয়েছি, অনুষ্ঠান শেষে চলে যাওয়ার সময় কেন্দুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন জুনিয়র শিক্ষকের দিকে এগিয়ে গিয়ে তার কাছে বিদায় নিতে দেখে। অনুষ্ঠানে আরডিসির জান্নাত-এ-ফেরদৌসীর খালি কণ্ঠে গাওয়া সলিল চৌধুরীর ‘হেইসামালো’ গানটি উপস্থিত সবার মন ছুঁয়ে গেছে। 

বক্তব্যে দুই শিক্ষক মহারথী তাদের কিছু দাবি সরকারের প্রতি তুলে ধরেন। দাবিগুলো হলো— কেন্দুয়ায় একটি পূর্ণাঙ্গ সাংস্কৃতিক একাডেমি, একটি হাই স্কুল ও একটি কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণ এবং নেজামপুর থেকে কেন্দুয়া যাওয়ার সড়কটি ‘রানী ইলা মিত্র সড়ক’ নামে নামকরণ ও তার জীবনী পাঠ্যপুস্তকে অন্তভুর্ক্তকরণ। আর আকন্দ স্যার তো ঘোষণাই দিলেন, তার বিশ্ববিদ্যালয়ে আদিবাসী সন্তানরা সামান্য খরচেই পড়াশোনার সুযোগ পাবে। এ ঘোষণা নিঃসন্দেহে খুশির খবর। আর বলতেও দ্বিধা নেই, হোক না প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়। বরেন্দ্র অঞ্চলে এঙ্মি ব্যাংক কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সাহস দেখিয়েছে, এটাই তো অনেক। তাছাড়া আমনুরায় ১২০০ বিঘার ওপর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস স্থাপিত হবে। 

খুব কাছ থেকেই দেখলাম এ দুই শিক্ষক মহারথীকে। কয়েক ঘণ্টা তাদের সান্নিধ্যে থাকার ফলে কিছু শেখাও হলো। কীভাবে কাজ করতে হয়, কীভাবে কাজের সঙ্গে লেগে থাকতে হয়... প্রভূত বিষয়। কাজে একাগ্রতা থাকলে তার ফল নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। আর সর্বোপরি আবদুল মান্নান আকন্দ স্যার বাইরের একজন হয়েও নাচোল নিয়ে বিশেষত তেভাগা তথা ইলা মিত্র নিয়ে তার যে গর্ব, তার যে ইচ্ছা-আকাক্সক্ষা সেসবের ছিটেফোঁটাও বোধহয় আমাদের মধ্যে নেই, সেটাই লজ্জার। দুই শিক্ষকসহ দেশের আরো অনেক মহারথীকে সঙ্গে নিয়ে সে লজ্জা কাটিয়ে আমরা নাচোলবাসী ইতিহাসের অংশ হয়েই থাকব— এই হোক আমাদের দৃঢ় প্রত্যয়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন