১ ফেব্রুয়ারি, সোমবার ভোর। কুয়াশার চাদরে মোড়া চারদিক। এই কুয়াশাঢাকা ভোরেই অন্যান্য দিনের মতো কলেজছাত্রীটি বের হয়েছিল বাড়ি থেকে, প্রাইভেট পড়তে। কিন্তু মেয়েটি সে দিন ঘুনাক্ষরে টের পায়নি, তার সামনে কি দুর্বিষহ যন্ত্রণা অপেক্ষা করছিল। জানলে হয়তো, বাড়িতেই আত্মগোপনের চেষ্টা করত। তা হয়নি। কৃষক পরিবারের সাদাসিধে, গ্রামের সবার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক মেয়েটির। নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্নও ওঠেনি। অথচ সেই মেয়েটিকে আজ পুলিশবেষ্টিত হয়ে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। আতঙ্কে,
নিরাপত্তাহীনতায় দিন কাটাতে হচ্ছে কলেজছাত্রীটিকে। শরীরের ১৫ স্থানে জখম নিয়ে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে কাতর হয়ে হয়তো সে সোমবার ভোরের বিভীষিকাময় ঘটনাটি রোমন্থন করছে বারবার।ভাষার মাসের শুরুর দিনে এরকম একটি অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটার আশাও করেননি কেউ; কিন্তু ঘটেছে। এটাই দুঃখজনক। ঘটনাটি ঘটেছে জেলার নাচোল উপজেলায়। পরদিন ২ ফেব্রুয়ারি চাঁপাই চিত্রে ঘটনাটি প্রধান সংবাদ হিসেবে পরিবেশিত হয়েছে। শিরোনাম ছিল ‘নাচোলে কলেজছাত্রীকে ধর্ষণে ব্যর্থ হয়ে দুবৃর্ত্তের ছুরিকাঘাত : মামলা দায়ের, একজন গ্রেফতার’। লেখার শুরুতে যা উল্লেখ করা হয়েছে, তা এ সংবাদের আলোকেই। আবার কোনো কোনো পত্রিকায় বলা হয়েছে, বিয়ে করতে রাজি না হওয়ায় এ ঘটনা ঘটেছে। থাক এ প্রসঙ্গ। আলোচনার বিষয়ও এটি নয়। মোদ্দা কথা, নাচোল ডিগ্রি কলেজে পড়ুয়া ওই ছাত্রীটি এক দুবৃর্ত্তের হাতে নির্মমভাবে ছুরিকাঘাতের শিকার হয়েছে। কেন হয়েছে, কি জন্য হয়েছে, কে করেছে— এসব খুঁজে বের করার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। তবে চাঁপাই চিত্রে পরদিন এ সম্পর্কিত আরো একটি সংবাদ প্রকাশিত হয় প্রধান হিসেবে— ‘নাচোলে কলেজছাত্রীকে ছুরিকাঘাতকারী যুবক শিবির ক্যাডার’। পুলিশের উদ্ধৃতি দিয়ে সংবাদটি পরিবেশিত হয়েছে। যে কোনো ঘটনারই ফলোআপ থাকা দরকার, চাঁপাই চিত্র সেটি করেছে। এজন্য ধন্যবাদ।
প্রথম দিনের সংবাদে ঘটনার কারণ সম্পর্কে আরেকটি তথ্য জানা যায়। সেটি হলো, কলেজছাত্রীটিকে পল্লীচিকিৎসক আবদুল ওহাব নামে এক ব্যক্তি বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন; কিন্তু পারিবারিকভাবে তা নাকচ করে দেয়ায় পল্লীচিকিৎসক ওহাব ছাত্রীটিকে হুমকিও দিয়েছিলেন। যথারীতি সন্দেহভাজন হিসেবে আবদুল ওহাবকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। কিন্তু মূল আসামি এখন পর্যন্ত (৫ ফেব্রুয়ারি) ধরাছেঁায়ার বাইরে। আশা করব, পুলিশ দ্রুতই প্রকৃত অপরাধীকে পাকড়াও করে বিচারের ব্যবস্থা করবে। প্রথম দিনের সংবাদের ভাষ্য অনুযায়ী, পুলিশের কাছে হুমকি দেয়ার কথা স্বীকার করলেও হামলার সঙ্গে কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না বলে দাবি করেছেন ওহাব। আবদুল ওহাব দাবি করতেই পারেন, তা যথাযথ প্রমাণের দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। তাছাড়া দুবৃর্ত্তের মুখ চাদরে ঢাকা থাকায় ছাত্রীটিও অপরাধীকে চিনতে পারেনি।
১ ফেব্রুয়ারি নাচোলে ওই কলেজছাত্রীর জীবনে ঘটে যাওয়া বর্বরোচিত হামলাটি শুধু তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে চাই না। এটা সত্য যে, বর্তমানে ওই ছাত্রীর পরিবার চরম উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা আর নিরাপত্তাহীনতায় দিন পার করছেন। এ ঘটনার ফলে এমনও হতে পারে যে, মেয়েটির হয়তো লেখাপড়াই বন্ধই করে দিতে পারে পরিবার শুধু নিরাপত্তাজনিত কারণে। এমনটি ঘটুক আমরা তাই চাই না। আর এরকম ঘটনা যাতে না ঘটে তার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সক্রিয় হতে হবে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এ ঘটনাটি কি আর অন্য কোনো কলেজছাত্রীর মধ্যে প্রভাব ফেলবে না? অবশ্যই ফেলবে। যদিও এ সম্পর্কিত কোনো সংবাদ চোখে পড়েনি। তবে ধারণা, মেয়েটির নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নাচোল ডিগ্রি কলেজসহ দেশের অন্যান্য স্কুল—কলেজের ছাত্রীরা, যারা এ ঘটনাটি গণমাধ্যমের কল্যাণে জানতে পেরেছে তাদের ভেতর এরই মধ্যে আতঙ্ক দানা বাঁধতে শুরু করেছে। কেননা সাদাসিধে একটি মেয়ে, যে গ্রামের সবার কাছেই ভালো বলে পরিচিত; এরকম একটি মেয়েকে যখন এ ধরনের ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়, তখন অন্যদের মনে ভয় প্রবেশ করাটাই স্বাভাবিক। কাজেই নাচোলে সংঘটিত ঘটনার প্রকৃত অপরাধীকে যতক্ষণ না খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা যাচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত অন্য স্কুল-কলেজছাত্রীর মন থেকে এ ধরনের আতঙ্ক দূর করা যাবে না। শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীই নয়, পাশাপাশি আইন সহায়তাকারী ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলোকেও এ বিষয়ে এগিয়ে আসতে হবে। মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে যেসব প্রতিষ্ঠান কাজ করছে তাদেরও এ বিষয়ে দ্রুত তৎপরত হতে হবে।
ব্যক্তিগতভাবে নাচোল ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম, এ ঘটনাটি অন্য মেয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া ফেলেছে কিনা তা জানার জন্য। তিনি জানিয়েছেন, এ ঘটনার পর কলেজ কতৃর্পক্ষ দ্রুতই অন্য মেয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে কাউন্সেলিং করেছে। তাদের মধ্যে যাতে আতঙ্ক না আসে সে বিষয়ে জোর দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি ঘন কুয়াশার সময়, কিংবা ফাঁকা-নির্জন রাস্তায় একাকী যাতায়াত না করার জন্য বলা হয়েছে।
নাচোল ডিগ্রি কলেজ কতৃর্পক্ষকে সাধুবাদ, দ্রুতই এ বিষয়ে শিক্ষার্থীদের নিয়ে কাউন্সেলিং করার জন্য। আশা রাখব, জেলার আর যেসব স্কুল-কলেজ আছে সেসব প্রতিষ্ঠানের মেয়ে শিক্ষার্থীদের নিয়েও যেন কাউন্সেলিং করা হয়; যাতে তাদের মধ্যে ভয় নামক শব্দটি প্রবেশ না করে। যদিও আমাদের অভ্যাস, কোনো ঘটনা থেকে শিক্ষা না নিয়ে পরক্ষণে সেটি ভুলে যাওয়া। আমাদের মধ্যেও যথেষ্ট সচেতনতার অভাব রয়েছে। দায়সারাভাবে যে কোনো বিষয়কে পর্যালোচনা করা হয়ে থাকে অনেক সময়। ‘নাচোলে ঘটেছে, অন্য জায়গাতে ঘটবে; এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই’— গোছের মনমানসিকতা অনেকের মাঝে বিরাজমান। সেটা ঝেড়ে সম্মিলিতভাবে সমাজের এ অসঙ্গতিগুলো দূর করতে আমাদেরকেই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে। আর তা হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরও অপরাধীদের শনাক্ত করতে সহজ হবে।
তারপরও প্রশ্ন থেকে যায়, প্রত্যেক অভিভাবকের পক্ষে কি সম্ভব প্রতিনিয়িত তাদের মেয়েকে স্কুল-কলেজ কিংবা প্রাইভেট পড়তে দিয়ে আসার? এ বিষয়টি ভেবে দেখবার দাবি রাখে বলে মনে হয়।
নাচোল থানার অফিসার ইনচার্জ তদন্ত ফাসিরউদ্দিনের সঙ্গেও কথা হয়েছিল এ বিষয়ে। ঘটনাটি অন্য কারোর মধ্যে প্রতিক্রিয়ার দরুন তাদের কাছে নিরাপত্তার জন্য কেউ যোগাযোগ করেছে কিনা, তা জানার জন্য। তিনি জানিয়েছেন, সেরকম কেউ আসেননি। তবে ঘটনাটি অনেক অভিভাবকের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে, তা তারা টের পাচ্ছেন। আর এজন্যই যত দ্রুত সম্ভব এ ঘটনার সুরাহা খুব জরুরি। সে লক্ষ্যেই নাচোল থানার পুলিশ কাজ করছে। জানালেন তিনি।
বক্তব্যটুকু নাচোল থানা পুলিশের। তারা কীভাবে কাজ করছেন কিংবা কত দ্রুত ঘটনাটির সুরাহা করছেন তা আমরা আগামীতে জানতে পারব। তবে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, তাদের তৎপরতার ওপরই নির্ভর করছে কলেজছাত্রীর ছুরিকাঘাতের ঘটনাটির দ্রুত সুরাহা।
পরিশেষে দুবৃর্ত্তের ছুরিকাঘাতে ক্ষতবিক্ষত কলেজছাত্রীর প্রতি সমবেদনা। তার পরিবারও যেন দ্রুত এ পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে, এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের খেয়াল রাখতে হবে। আহত ওই ছাত্রীসহ দেশের সব স্কুল-কলেজের মেয়ে শিক্ষার্থীদের বলব, ভয় পেও না, রুখে দাঁড়াও। নিজেদের দুর্বল ভেবে নত হয়ো না, শির উঁচু করে চলো এবং অন্যায়কে প্রতিহত করো। সমাজকে কলুষমুক্ত করার দায়িত্ব তোমার—আমার—সবার...।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন