শনিবার, ১৪ মে, ২০২২

রানীমা ইলা মিত্রের মৃত্যুবার্ষিকী আজ

দৈনিক চাঁপাই চিত্র, চাঁপাইনবাবগঞ্জ; ১৩ অক্টোবর ২০১৫


আজ ১৩ অক্টোবর, ২০১৫ সংগ্রামী কৃষক নেতা, বাঙালি মহীয়সী নারী ও তেভাগা আন্দোলনের অন্যতম নেতা রানীমা ইলা মিত্রের ১৩তম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০০২ সালের এ দিনে তিনি কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। নাচোল তাঁকে নিয়ে কাজ করার সুবাদে আজও কিছু স্মৃতি জাজ্বল্যমান। সেসব স্মৃতি বলার আগে সংক্ষেপে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনবৃত্তান্ত তুলে ধরা হলো।

নাচোলের ইতিহাসের উজ্জ্বল নক্ষত্র রানীমা ইলা মিত্রের জন্ম ১৯২৫ সালে। ১৯৪৪ সালে তিনি বেথুন কলেজ থেকে বাংলায় অনার্স পাস করেন। এরপর ১৯৫৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করে ওই বছরই কলকাতার সিটি কলেজে (সাউথ) অধ্যাপনা শুরু করেন। অধ্যাপনা থেকে অবসর নেন ১৯৯০ সালে। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত তিনি পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার এমএলএ ছিলেন। তিনি ভালো দৌড়বিদও ছিলেন। ১৯৪৪ সালে বিশ্ব অলিম্পিকে ভারতবর্ষের একজন দৌড়বিদ নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৩৫ সালে বিপ্লবী রমেন মিত্রের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁদের একটি সন্তানও রয়েছে। তবে এসব পরিচয় ছাপিয়ে নাচোলের সাঁওতাল কৃষক আন্দোলনের নেত্রী হিসেবেই তিনি ইতিহাসখ্যাত। সাঁওতাল কৃষকরা যাকে ভালোবেসে ‘রানীমা’ উপাধি দিয়েছিল। মহীয়সী এই নারী শোষিত, বঞ্চিত কৃষকদের অধিকার আদায় প্রতিষ্ঠায় সংগ্রাম করেছেন। এ জন্য সয়েছেন অমানুষিক নির্যাতন। 

রানীমা ইলা মিত্র স্বামীর হাত ধরেই রাজনীতিতে যুক্ত হন। ১৯৪৮ সালে তিনি নাচোলে সাঁওতাল কৃষকদের তেভাগা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫০ সালের ৭ জানুয়ারি বিদ্রোহী কৃষকসহ ভারত পাড়ি দেবার সময় রহনপুর স্টেশনে ধরা পড়েন। রানীমাসহ ৩১ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে তৎকালীন সরকার। এরপর রানীমার ওপর চলে অমানুষিক নির্যাতন। যে নির্যাতনের কথা শুনলে এখনো গা শিউরে ওঠে। ১৯৫১ সালের ১১ জানুয়ারি মামলার রায় ঘোষিত হয়। রায়ে রানীমার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রিজন ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন থাকাকালে ১৯৫৪ সালে উন্নত চিকিৎসার জন্য তিনি প্যারোলে মুক্তি পেয়ে কলকাতা যান এবং সেখানেই কর্মজীবন শুরু করেন। দেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭২ সালে রানীমা ইলা মিত্র বাংলাদেশে এসেছিলেন। দ্বিতীয়বার এসেছিলেন ১৯৯৩ সালে, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের আমন্ত্রণে। [তথ্যসূত্র ‘নাচোলে ইলামিত্র’, নভেম্বর, ১৯৯৬]


সারা দেশের মানুষ নাচোলকে তেভাগা আন্দোলন তথা রানীমা ইলা মিত্রের জন্যই এক নামে চিনে। ঢাকায় থাকাকালে নাচোল বাড়ি বললেই মানুষের মন্তব্য ছিল, ‘আপনি তো ভাই বিখ্যাত এলাকার মানুষ।’ তবে ইতিহাসখ্যাত নারী রানীমা ইলা মিত্রের কারণে নাচোলের পরিচিতি হলেও, তাঁর আদর্শকে আমরা কতটুকু লালন করতে পেরেছি কিংবা তাঁর আদর্শকে আমরা পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পেরেছে সে প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায়। আমরা ঘটা করে তেভাগা আন্দোলনের কথা স্মরণ করি। কিন্তু যে আদর্শের ভিত্তিতে, যে স্বপ্নকে লালন করে কৃষক তথা সাঁওতাল কৃষকরা আন্দোলনের পথে এগিয়ে যাচ্ছিল, সে আন্দোলন তথা আন্দোলনের আদর্শের বীজ আমরা কতটুকু বপন করতে পেরেছি? 

আজ রানীমা ইলা মিত্রের ১৩তম মৃত্যুবার্ষিকী। তাঁর মৃত্যুর এতটা সময় পেরিয়ে গেলেও একটা চাপা কষ্ট বুকের ভেতর আজও বিদ্যমান। তবে সান্ত¦না পাই এ ভেবে যে, রানীমা নাচোল আসার পেছনে আমাদের গুটিকয় তরুণেরও কিছু ভূমিকা ছিল; যা গর্ব করে বলতে পারি। এবং সে কথা আজকে তুলেও ধরতে চাই সবার কাছে। 

মৃত্যুর ছয় বছর আগে নাচোল এসেছিলেন রানীমা ইলা মিত্র। তার আগে বেশ কয়েকবার এ দেশে এলেও কখনো নাচোল আসেননি। না আসার কারণ সম্পর্কে সম্ভবত ১৯৯৩ সালে মৃগাঙ্ক সিং নামে এক লেখকের (তার প্রকাশিত একটি বইয়ের নাম সম্ভবত ‘বনমোরগের ডাক’) কাছ থেকে জানতে পেরেছিলাম। তিনি আমাকে জানিয়েছিলেন, ‘কেন নাচোল যান না’— এ প্রশ্নও তিনি রানীমাকে করেছিলেন। রানীমার জবাব ছিল, নাচোলবাসী স্মরণ করলে তিনি নাচোল যাবেন। 

এর পর অনেক চেষ্টা চালিয়ে ১৯৯৫ সালের শেষ দিকে কয়েকজন মিলে নাচোলে রানীমা ইলা মিত্রের নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলাম। পরের বছর অর্থাৎ ১৯৯৬ সালের জুনে তেভাগা আন্দোলন ও ইলা মিত্রের ওপর আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। আলোচনা সভায় অতিথি ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সে সময়ের খ্যাতিমান তিন শিক্ষক— প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক, প্রাবন্ধিক শহিদুল ইসলাম ও কবি-সাহিত্যিক জুলফিকার মতিন। এ কথা ঠিক যে, সে আলোচনা সভা ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল নাচোলের বাইরেও। 

এর দুই-তিন মাস পর বাম নেতা ফজলে হোসেন বাদশা ভাই আমাকে ডেকে পাঠান। যথারীতি তার সঙ্গে দেখা করি। তিনি আলোচনা সভা করার জন্য ধন্যবাদ জানান। কথা প্রসঙ্গে বলেন, ‘আলোচনা সভার খবর ইলা দিকে জানানো হয়েছে। তিনি খুবই খুশি হয়েছেন এবং নাচোল আসতে চাচ্ছেন।’ রানীমা আসতে চাচ্ছেন শুনে সেদিন খুব গর্ব অনুভব করছিলাম। যাক, কিছুটা হলেও আমরা সাড়া ফেলতে পেরেছি। 

এর পর সত্যিই রানীমার নাচোল আসার দিনক্ষণ ঠিক করে অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে ফজলে হোসেন বাদশা ভাই আবারও ডেকে পাঠালেন। খবরটা শুনে সে দিন আনন্দে চোখে জল গড়িয়ে পড়ার উপক্রম হয়েছিল। রানীমার নাচোল আগমন উপলক্ষে কমিটি গঠন করা হলো। কমিটির নাম দেয়া হলো— ‘তেভাগা কৃষক আন্দোলনের ৫০ বছর পূর্তি উদযাপন কমিটি’। আমার ওপর দায়িত্ব পড়ল পত্রিকা বের করার। অথচ সময় মাত্র ১৫ দিন। এই ১৫ দিনের মধ্যেই লেখা সংগ্রহসহ পত্রিকা বের করতে হবে। দুরূহ একটা ব্যাপার ছিল তখনকার জন্য। কারণ সে সময় শুধু রিপোর্ট লিখে পত্রিকা অফিসে পাঠিয়েছি; কিন্তু পত্রিকা কীভাবে বের করতে হবে সে সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না। পত্রিকার নাম ঠিক হয় ‘নাচোলে ইলা মিত্র’। ভুল-ত্রুটি যা-ই থাক না কেন, পত্রিকাটি শেষ পর্যন্ত বের করতে পেরেছিলাম— এই ছিল সান্ত্বনা। আর যে ব্যক্তিটির কারণে এ দুরূহ কাজটি করা সম্ভব হয়েছিল, তিনি হলেন সে সময়ের রাজশাহীর সাপ্তাহিক গণখবর পত্রিকার সম্পাদক মাহতাব উদ্দিন। 

অবশ্য এর আগে বাদশা ভাইকে বলে রানীমার সাক্ষাৎকার নেয়ার ব্যবস্থা করি। ঠিক হয় নাচোলের জনসভার পরদিন চাঁপাইনবাবগঞ্জ সার্কিট হাউসে বসে সে সাক্ষাৎকার নেয়া হবে। 

এলো সে মাহেন্দ্রক্ষণ, ৬ নভেম্বর ১৯৯৬। সে দিন নাচোল কলেজ মাঠে সাঁওতাল ছাড়াও নানা বর্ণের মানুষের ঢল নেমেছিল। শুধু মানুষ আর মানুষ। তিল ধারণের জায়গাটুকুও ছিল না। এর পর মঞ্চে উঠলেন তেভাগা আন্দোলনের বিপ্লবী নেতা ইলা মিত্র। রোগাক্রান্ত দেহ, সোজা হয়ে হাঁটতেও পারছিলেন না। অথচ এ মানুষটিই তৎকালীন সরকারের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন, ভাবাই যায় না। যাকে কখনো দেখতে পাব বলে ভাবিনি, সেই রানীমাকে এত কাছ থেকে দেখতে পাব, আশাও করিনি। আশার বাস্তবায়ন ঘটলে ভেতরে কী অনুভূতি হয়, তা হয়তো লিখে বোঝানো কঠিন। 

এর পর রানীমাকে নিজ হাতে ‘নাচোলে ইলামিত্র’ পত্রিকাটি দিলাম। উপহার হিসেবে একটি ওয়ালম্যাটও তুলে দিলাম তার হাতে। পর দিন ৭ নভেম্বর নির্ধারিত ছিল তার সাক্ষাৎকার নেব। কিন্তু কষ্টের বিষয় এই যে, আমার যাওয়া হয়নি তার কাছে। ক’জন শুভাকাঙ্ক্ষী আমার নাম করে রানীমার সঙ্গে সময় কাটিয়ে এলেও দুর্ভাগ্য আমারই, সুযোগ পেয়েও তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করা হলো না। সেই কষ্টটা আজও সযতনে বয়ে বেড়ায়...

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন