২৬ জানুয়ারি ২০১৬
সরোজ গুপ্ত ক্যানসার সেন্টারের আগের নাম ‘ক্যানসার সেন্টার ওয়েলফেয়ার হোম অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট’। এর প্রতিষ্ঠাতা ডা. সরোজ গুপ্ত মারা যাবার পর প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন করে ‘সরোজ গুপ্ত ক্যানসার সেন্টার অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ রাখা হয়। সরোজ গুপ্তের ছেলে ডা. অর্নব গুপ্ত প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে রয়েছেন। এ সেন্টারটিতে জরায়ু থেকে শুরু করে গলা পর্যন্ত টিউমার-ক্যানসার চিকিৎসার জন্য ভালো বলে পশ্চিমবঙ্গের মানুষদের মুখ থেকে শোনা যায়।
হাওড়া ও শিয়ালদহ স্টেশন থেকে প্রায় ঘণ্টাখানেকের পথ। ট্যাক্সি-বাস দুটোতেই যাওয়া যায়। তবে শিয়ালদহ থেকে সরাসরি বাস সার্ভিস খুবই কম। সরোজ গুপ্ত ক্যানসার সেন্টার সম্পর্কে জানতে হলে তাদের নির্ধারিত ওয়েবসাইট ভিজিট করতে পারেন। সেখানে বিস্তারিত সব কিছুই তুলে ধরা আছে। পরিবেশ বেশ চমৎকার এবং সবকিছুই পরিপাটি। শুধু সরোজ গুপ্তই নয়, টাটারও পরিপার্টি সম্পর্কে বিশদ বর্ণনা দিতে গেলে লেখার পরিসর আরো দীর্ঘ হবে। সেদিকে যাচ্ছি না।
কলকাতায় সরোজ গুপ্ত ক্যানসার সেন্টার ছাড়াও আরো কয়েকটি হাসপাতাল আছে, যেখানে বাংলাদেশীরা যাচ্ছেন। এগুলোর মধ্যে আছে— পিয়ারলেস ও অ্যাপোলো গ্লিনগলস হাসপাতাল। হাড়-গোড়ের চিকিৎসায় ফোরটিস হাসপাতালের নামও শোনা যায়। এসব হাসপাতাল কলকাতার বাইপাস সড়ক ও নিউটাউনের দিকে। অ্যাপোলো হাসপাতালে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। সেখানে ফরেন ডেস্ক আলাদা। পাসপোর্ট দেখিয়ে নির্ধারিত ফরম পূরণ করতে হয়। অ্যাপোলোতে রেজিস্ট্রেশন ফি ২০০ রুপি। চিকিৎসক দেখানোর ফি আলাদা। আমি নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞকে দেখিয়েছিলাম, তার ফি ছিল ৪০০ রুপি। অ্যাপোলোতে যে চিকিৎসককে আমি দেখিয়েছিলাম, সেই চিকিৎসকের কাছেই এসএ টিভির নিউজ এডিটর শিপন হালদারও চিকিৎসা করিয়েছেন। মূলত তার পরামর্শেই সে চিকিৎসকের কাছেই যাওয়া। হাসপাতালের পরিবেশ ভালো। যথারীতি সেখানেও দেখা হয় অন্য বাংলাদেশীদের সঙ্গে। একজন তো বলেই ফেললেন, জ্বরের চিকিৎসা করতেও তিনি কলকাতায় আসেন। তবে কলকাতার চেয়ে চেন্নাইয়ের অ্যাপোলোর নামডাক বেশি। ভারতীয়-বাংলাদেশীরা মূলত সেখানেই যান। যমুনা টেলিভিশনের সাংবাদিক বন্ধু মনোয়ার হোসেন জুয়েলও একবার সেখানেই অপারেশন করিয়ে এসেছিলেন।
চেন্নাইয়ের আরো একটি হাসপাতাল বর্তমানে বাংলাদেশীদের কাছে বেশ নাম করেছে, সেটি হলো— ভেলোরের ক্রিশ্চিয়ান মেডিকেল সেন্টার। যেটি সিএমসি নামে বেশি পরিচিত। সেখানে যাওয়ার সুযোগ হয়নি, আত্মীয়পরিজন যারা গেছেন, তাদের মুখেই শুনেছি। সিএমসিতে চিকিৎসাব্যবস্থা খুবই ভালো, তবে অপারেশনের সিরিয়াল পেতে অনেক দেরি হয়। যে কারণে অনেকেই আবার সিএমসি বাদ দিয়ে অন্য কোথাও চিকিৎসা শুরু করে দেন। এর কারণও আছে। কেননা, একজন রোগীকে নিয়ে ভেলোরে গিয়ে চিকিৎসা করানো পর্যন্ত যে টাকা খরচ হয় তাতে অপারেশনের জন্য দুই-তিন মাস অপেক্ষা করা অনেকের পক্ষে সম্ভব হয় না। অবশ্য না গেলেও সিএমসির একটা বিষয় ভালো লেগেছে, তা হলো মেইলের রিপ্লাই দেয়া। মায়ের চিকিৎসার কাগজপত্র পাঠিয়ে অ্যাপয়েন্টমেন্ট চেয়েছিলাম। কয়েকটি দফতরে মেইল করা হয়েছিল। সব দফতর থেকেই প্রতিউত্তর এসেছিল। তবে তারা যে প্রক্রিয়ায় যাবার কথা বলেছিল, সেটি সম্ভব হয়নি।
সিএমসিতে চিকিৎসা খরচ কম হলেও আশপাশের আনুষঙ্গিক খরচ বেশি। অর্থাৎ থাকা-খাওয়া। ওখানেও থাকার জন্য লজ ভাড়া পাওয়া যায়। তবে খাওয়ার কষ্টটাই বেশি। কেননা দক্ষিণ ভারতীয়দের খাবার পশ্চিমবঙ্গের মানুষরাই যেখানে খেতে দ্বিধাবোধ করে, সেখানে বাংলাদেশীদের কি অবস্থা! তা তো অনুমান করাই যায়। যে কারণে বেশির ভাগ বাংলাদেশীই সেখানে রান্না করে খেয়ে থাকেন।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে ছোট মামারও গলব্লাডারে টিউমার ও ক্যানসার ধরা পড়ায় দেরি না করে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল মুম্বাইয়ের টাটা মেমোরিয়াল সেন্টারে। টাটা হাসপাতালটির অবস্থান মুম্বাইয়ের দাদারে। মামা ৪ সেপ্টেম্বর এয়ার ইন্ডিয়ার ঢাকা থেকে কলকাতা হয়ে মুম্বাইয়ের ফ্লাইট ধরেছিলেন। আমি যাই মালদা হয়ে। সৌভাগ্যক্রমে আমি এয়ার ইন্ডিয়ার সেই ফ্লাইটে টিকেট পাই কলকাতা থেকে। এজন্য ভাড়া গুনতে হয়েছিল ৭ হাজার ৩০০ রুপি। কলকাতা থেকে অনেক এয়ারলাইন্সেরই ফ্লাইট মুম্বাই যায়। ভাড়ার রকমফের আছে। ভায়া হয়ে গেলে খরচ একটু কম পড়ে। আবার কোনো কোনো দিন প্রচুর ডিসকাউন্টও পাওয়া যায়।
টাটায় গিয়ে শুরুতেই একটু হোঁচট খেতে হয়। কেননা, মামা সরকারি চাকুরে, অফিসিয়াল পাসপোর্ট। ভিসা বলতে ছুটির কাগজ। কিন্তু রিসিপশনে দায়িত্বরত নারী কর্মকর্তা মেডিকেল ভিসা ছাড়া ফরম দেয়া যাবে না বলে জানিয়ে দেন। বাংলাদেশী সরকারি চাকুরেদের অফিসিয়াল পাসপোর্টে কোনো ভিসা লাগানো হয় না— তাকে এ কথা বোঝাতে ব্যর্থ হলাম। অনেকটা পর তিনি জানালেন, সিকিউরিটি যদি অনুমতি দেয় তাহলে তিনি ফরম দিতে পারবেন। বলে রাখা ভালো, বাংলাদেশী যারা মুম্বাইয়ের টাটা মেমোরিয়ালে চিকিৎসা করতে যেতে ইচ্ছুক, তারা অবশ্যই যেন মেডিকেল ভিসা লাগিয়ে সেখানে যান। শুধু তাই নয়, সঙ্গে যাকে নেবেন তারও মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে ভিসা থাকতে হবে। কেননা হাসপাতালটি সরকার নিয়ে নিয়েছে। যদিও সেখানে প্রাইভেটে চিকিৎসা হচ্ছে এবং তার জন্য খরচও বেশি পড়ে। আর জেনারেল চিকিৎসা শুধু ভারতীয়দের জন্য সংরক্ষিত।
যাহোক, পড়িমড়ি করে টাটার আন্ডারগ্রাউন্ডে সিকিউরিটি সেলে যাই। সেখানকার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে পুরো বিষয়টি বুঝিয়ে বলার পর একটি স্লিপ লিখে দেন ফরম দেয়ার জন্য। সেটি নিয়ে আবার রিসিপশনে ফরম পূরণ করে আবার সিকিউরিটি সেলে যাই। কেননা ফরম পূরণ করার পর সিকিউরিটির ক্লিয়ারেন্স পেলে, রেজিস্ট্রেশন করা যায়। সিকিউরিটি সেল থেকে ক্লিয়ারেন্স নিয়ে যাই রেজিস্ট্রেশন কাউন্টারে। সেখানে ফরমালিটিজ মেইনটেইন করে মামার ছবি তুলে সঙ্গে সঙ্গে একটি ডিজিটাল আইডি কার্ড দেয়। টাটাতে চিকিৎসা করতে হলে প্রথমেই ৫০ হাজার রুপি ডিপোজিট করতে হয়। টাকা জমা দেয়ার কাউন্টার আলাদা। তবে ক্রেডিট কার্ডে পরিশোধ করতে চাইলে রেজিস্ট্রেশন কাউন্টারেই জমা দেয়া যায়। পরীক্ষা-নিরীক্ষার যাবতীয় বিল সে টাকা থেকে সমন্বয় করা হয়। এজন্য শুধু আইডি কার্ডটি প্রত্যেক বিভাগে জমা দিতে হবে। বলা যায়, আইডি কার্ডটিই ক্রেডিট কার্ডের মতো। কার্ড পাঞ্চ করেই টাকা কেটে নেয়া হয়। যা বিল কিংবা যে পরিমাণ টাকা কেটে নেয়া হয় তা সঙ্গে সঙ্গেই সেলফোনে মেসেজ দেয়া হয়। টাকা কমে এলে মেসেজ দিয়ে টাকা ডিপোজিট করতে বলা হয়। টাটা হাসপাতালের পুরো কার্যক্রমই কম্পিউটারাইজড। রোগীকে ডাকাও হয় ডিসপ্লের মাধ্যমে। মনিটরে রোগীর নাম, আইডি নম্বরসহ কত নম্বর রুমে যেতে হবে, তা উল্লেখ করে দেয়া থাকে। রোগী সম্পর্কে যাবতীয় নোট কম্পিউটারে আপলোড করা হয়। চিকিৎসকরা রোগীর সঙ্গে কথা বলেন, আর তার কেস হিস্ট্রি কম্পিউটারে লিপিবদ্ধ করেন। যে কথাটি বলা হয়নি তাহলো, ফরম পূরণের সঙ্গে সঙ্গেই রোগীর নামে একটি ওয়েব আইডি তৈরি হয়ে যায় এবং সে রোগীর যাবতীয় ডকুমেন্টস ওই আইডিতে চলে যায়। বিশ্বের যে কোনো স্থান থেকেই রোগীর সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য ওই আইডির মাধ্যমে পাওয়া যায়, যা অন্য কারো সঙ্গে আলোচনা করতে সুবিধা হয়।
টাটার চিকিৎসা খরচ তুলনামূলকভাবে বেশি। সবচেয়ে বেশি খরচ সেখানে থাকাটা। হাসপাতালের আশপাশে লজের ভাড়া প্রচুর। প্রতিদিন ১২০০ থেকে শুরু করে ৩ হাজার রুপি পর্যন্ত। একটু বাইরে গেলে কম ভাড়ায় রুম পাওয়া যায়। তবে তার জন্য আবার আলাদা ট্যাক্সি ভাড়া গুণতে হবে। ইন্ডিয়ার বাণিজ্যিক এলাকা হিসেবে মুম্বাই খুব পরিচ্ছন্ন। ট্যাক্সি সবসময় পাওয়া যায়। কলকাতা থেকে পথও অনেক দূর, প্রায় ২ হাজার কিলোমিটার। যথারীতি সেখানেও বাংলাদেশী মানুষকেও দেখেছি। তবে সেটা কলকাতা কিংবা চেন্নাইয়ের তুলনায় কম।
টাটার নিয়ম-কানুন তথা লজে থাকতে হলে প্রচুর নিয়ম মেনে চলতে হয়। আর বাংলাদেশীদের জন্য আরো বেশি। যদি ডিপোজিট তুলতে চান তাহলে সারাদিন পার হয়ে যাবে দফতর ঘুরতে ঘুরতে। তাছাড়া পাসপোর্টের একগাদা ফটোকপি জমা দিতে হয় বিভিন্ন জায়গায়। একটানা ১৪ দিন থাকলে সেখানকার সিআইডিতে রিপোর্ট করতে হয়। যে লজে থাকা হবে, সেখানেও সিআইডি কয়েকবার হানা দেবে, খেঁাজখবর নেয়ার জন্য। মুম্বাই গেলে এ বিষয়গুলো খেয়াল রাখতে হবে।
ইন্ডিয়ার যে কোনো হাসপাতাল সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে চাইলে গুগলে গিয়ে সার্চ দিলেই সে হাসপাতালের ওয়েব ঠিকানা পাওয়া যাবে। সে ঠিকানায় ঢুকলেই হাসপাতাল সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য পাওয়া যাবে।
কি কারণে মানুষ ইন্ডিয়া চিকিৎসা করতে যাচ্ছেন, সে সম্পর্কে গত সংখ্যায় আলোচনা করা হয়েছে। কাজেই সেদিকে আর যাচ্ছি না। তবে এটা ঠিক যে, সেখানকার হাসপাতালগুলো সম্পর্কে লিখতে গেলে বিস্তৃত পরিসর দরকার। এখানে শুধু অল্প কথায় বর্ণনা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে মাত্র।
পরিশেষে যে কথাটুকু না বললেই নয় তাহলো, দেশে ভালো চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার। চিকিৎসকদের আচরণে পরিবর্তন আনা দরকার। সব চিকিৎসকই যে একরকম, তা বলছি না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই চিকিৎসকের আচরণ নিয়ে অনেকেই অভিযোগ করেন। তাছাড়া দেশীয় চিকিৎসাব্যবস্থার প্রতি আস্থা গড়ে তুলতে সরকারকেই পদক্ষেপ নিতে হবে। কেননা ভুক্তভোগীর সংখ্যা যে হারে বাড়ছে, তাতে আস্থা গড়ে তুলতে না পারলে নিতান্তই বাধ্য ছাড়া আর কেউই এ দেশে চিকিৎসা করতে চাইবেন না। দেশের উপজেলা শহরগুলোয় যেসব ক্লিনিক গড়ে উঠেছে, সেসব জায়গাতে ভুল চিকিৎসায় যেন কেউ মৃত্যুবরণ না করেন, সে বিষয়েও নজরদারি রাখতে হবে। আস্থার প্রতিদান পেলে, নিশ্চয়ই এ দেশের রোগীরা ইন্ডিয়ায় চিকিৎসা করতে যাওয়া থেকে বিরত হবেন। আগামীতে এ দৃশ্য দেখারই আশাবাদ ব্যক্তি করি। (শেষ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন