সোমবার, ১৬ মে, ২০২২

ইন্ডিয়ায় চিকিৎসা-১ : কেন যাচ্ছেন বাংলাদেশী রোগীরা?

দৈনিক চাঁপাই চিত্র, চাঁপাইনবাবগঞ্জ; ১১ জানুয়ারি ২০১৬


চাঁপাই চিত্রে প্রকাশিত ক্লিনিক নিয়ে এক লেখায় বলা হয়েছিল, দেশে ভুল চিকিৎসার হার বেড়েই চলেছে। যে কারণে দেশের মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বেশির ভাগ মানুষ ধারদেনা করে হলেও পার্শ্ববর্তী দেশ ইন্ডিয়ায় যাচ্ছেন উন্নত চিকিৎসার জন্য। কেন যাচ্ছেন, ওখানকার চিকিৎসা ব্যবস্থাইবা কেমন?— এ বিষয়ে চাঁপাই চিত্রে লেখার ইচ্ছা পোষণ করা হয়েছিল ওই লেখায়। সে জায়গা থেকেই এ লেখার অবতারণা। বলে নেয়া ভালো, লেখার শুরুতে ব্যক্তিগত প্রসঙ্গই বেশি আসবে এবং সেটি প্রয়োজনের তাগিদেই। তাই আগে থেকে পাঠকদের কাছে মার্জনা চেয়ে নিচ্ছি। 

প্রথম ইন্ডিয়া ভ্রমণ চিকিৎসাজনিত কারণে হবে, তা আগে কখনোই ভাবিনি। ঢাকায় দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা জীবন পার করে ২০১৩ সালের মাঝামাঝি থেকে বারবারই মনে হচ্ছিল আমার গ্রামের বাড়ি ফিরে যাওয়া উচিত— মা-বাবাকে সময় দেয়ার জন্য। কেননা বয়সের ভারে দিন দিন তারা ভারাক্রান্ত হচ্ছেন। বাবাও সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। মা-হারা একমাত্র ভাগনিরও দেখভাল করা দরকার। আর ঢাকা থেকেও প্রতি মাসে নাচোল যোগাযোগ করে ওঠা সম্ভবপর হয়ে উঠছিল না চাকরির সুবাদে। তাই শেষমেষ সিদ্ধান্ত স্থির হলো, গ্রামের বাড়ি অর্থাৎ নাচোলেই ফিরে আসার। ২০১৪ সালের এপ্রিলের শেষ দিকে ফিরে আসি নাচোলে। ১ মে থেকে ছোট্ট একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ‘ভূমি মুদ্রণ ঘর’ দাঁড় করানোর চেষ্টা করি। চেষ্টা এই কারণে যে, পৈতৃক সূত্রে বাড়ি নাচোলে হলেও ৩৮ বছরের জীবনে এখানে এর আগে সর্বসাকুল্যে গোটা তিন-চারেক বছর থাকা হয়েছে। যদিও ওই সময়টুকুতে সাংবাদিক হিসেবে পরিচিতি যথেষ্টই ছিল। তবে দীর্ঘ দূরত্বের কারণে মানুষ যতটা নামে চেনে, চেহারায় ততটা নয়। তাই কচ্ছপের গতিতে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে এগোনো। পাশাপাশি নিয়মিত কলাম লেখা— এই ছিল রুটিন।  

কিন্তু এ রুটিন বেশি দিন বহাল থাকল না। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরের ঘটনা। মা ব্রেস্ট সমস্যাজনিত কারণে গেল রাজশাহী চিকিৎসা করাতে। তখন ছোট বোন থাকত রাজশাহীতে, কেয়ার বাংলাদেশে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট হিসেবে কর্মরত থাকার দরুন। পপুলারে দেখানো হলো প্রফেসর ডা. হাসিনা আখতারকে। অন্যান্য পরীক্ষার পাশাপাশি তিনি এফএনএসি (ফাইন্ড নিডিল অ্যাসপারেশন সাইটোলজি— এক ধরনের বায়োপসি) করার জন্য বললেন। এফএনএসি করা হলো। রিপোর্ট পেয়ে চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলার আগেই আমাকে ফোন দিয়ে কাঁদতে শুরু করে বোনটি। জিজ্ঞেস করতেই বলে, ‘রিপোর্ট ভালো না। ডাকটাল কারসিনোমা। অর্থাৎ ব্রেস্ট ক্যানসার। তুমি দেরি না করে রাজশাহী চলে এসো।’

নাচোল আসা সবেমাত্র চার মাস হয়েছে। এর মধ্যেই এ খবর! চোখেমুখে অন্ধকারই দেখছিলাম সে সময়। কেননা পরিস্থিতি সামাল দেব কীভাবে— এ আশঙ্কায়। কেননা কয়েকদিন আগেই এ অসুখেই মায়ের খালাতো ভাবি মারা গেছেন। কাজেই মা জানতে পারলে সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়বে, হয়তোবা হিতে বিপরীতও হতে পারে। বাবাকেই বা বলি কীভাবে? ২০১২ সালে এক দুর্ঘটনায় আরেক ছোট বোন মারা যাবার পর বলতে গেলে বাবা পুরোপুরি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। সে জায়গায় এ কথা বলাও কঠিন। যাক, চোয়াল শক্ত করলাম। ভাবলাম, দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে আর পরিস্থিতিও ধীরস্থিরভাবে সামাল দিতে হবে। 

কাজ বিশেষে রাজশাহী যাওয়ার কথা বললাম বাবাকে। আরো বললাম, মায়ের রিপোর্টগুলো চিকিৎসককে দেখানো দরকার। এক সঙ্গে দুটি কাজই হয়ে যাবে। রাজশাহীতে গিয়ে দেখা করি চিকিৎসকের সঙ্গে। চিকিৎসকের চেম্বারে গিয়ে চক্ষু চড়কগাছ, ভেতরের অবস্থা দেখে। রোগীতে ঠাঁসাঠাসি। এ দৃশ্য এর আগে কখনোই দেখিনি। যা দেখেছি তা হলো চিকিৎসক একজন একজন করে ডেকে রোগী দেখেছেন। ভাবলাম, এখন বোধহয় নিয়ম বদলেছে! যাক সে কথা। 

চিকিৎসক প্রথমে জানার চেষ্টা করলেন আমি অভিভাবক কিনা। হ্যাঁ বলাতে দেরি না করে সোজাসুজি বলেই দিলেন মায়ের ব্রেস্ট ক্যানসার। ইমিডিয়েটলি অপারেশন করতে হবে। জানতে চাইলাম, ক্যানসারের স্টেজটা কোন পর্যায়ে? কত দিনই বা হাতে সময় পাবো প্রভৃতি বিষয়। কিন্তু কোনো উত্তর পাইনি। একটাই কথা— এক্ষুনি অপারেশন করে ফেলতে হবে। যাহোক উনি লক্ষ্মীপুর মোড়ে অবস্থিত একটি ক্লিনিকের একজন সার্জনের কাছে রেফার্ড করলেন। দেরি না করে গেলাম তার কাছে। উনার আচরণে মনে হলো, রোগীর চেয়ে হিসাব-নিকাশ করাটাই তার কাছে জরুরি। কথা না বাড়িয়ে চলে আসি। কথা বলি আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে। বেশির ভাগেরই অভিমত ইন্ডিয়া নিয়ে যাওয়ার জন্য। কেউ বলল, ভেলোর; কেউ বলল, চেন্নাইয়ের অ্যাপোলো; কেউ বলল, মুম্বাইয়ের টাটা; কেউ বলল, কলকাতায় যেতে। বাংলাদেশেও যে এ রোগের চিকিৎসা হয় না, তা নয়। অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং অনেক সময় ভুল চিকিৎসার শিকার হতে হয়, বিধায় ইন্ডিয়া নিয়ে যাওয়ায় ভালো— এ ছিল অনেকের যুক্তি। 

শুভাকাক্সক্ষীদের পরামর্শকে শ্রদ্ধা জানিয়ে ইন্ডিয়া যাওয়ার প্রস্তুতি নিই। জরুরিভাবে পাসপোর্ট তারপর ভিসা করে ওই বছরের অক্টোবরের ২৫ তারিখ কলকাতায় পেঁৗছাই। তবে তার আগে ভেলোরের সিএমসি, মুম্বাইয়ের টাটা মেমোরিয়াল এবং কলকাতার সরোজ গুপ্ত ক্যানসার সেন্টারসহ ইন্ডিয়ার আরো বেশ কয়েকটি হাসপাতালে মায়ের কাগজপত্রসহ মেইল করি। প্রতিউত্তর এসেছিল শুধু সিএমসি থেকে। শুভাকাক্সক্ষীদের মধ্যে অবশ্য ভেলোরের সিএমসিতে যাওয়ার পরামর্শ ছিল বেশি। কিন্তু আমার ভাবনা ছিল, চেন্নাই যাওয়া হয়তো বড় বিষয় নয়, সমস্যা ছিল ভাষা। আর প্রথম যাওয়া। কাজেই কলকাতা হলে ভালো হয়। এ ভাবনা থেকেই কলকাতায় চিকিৎসা করার সিদ্ধান্ত নিই। তাছাড়া কলকাতার ওই হাসপাতালে অর্থাৎ সরোজ গুপ্ত ক্যানসার সেন্টারে আমার বাল্যবন্ধুর মায়ের অপারেশন হয়েছিল। সে সূত্রে হাসপাতালটি সম্পর্কে পূর্ব থেকেই এক ধরনের ধারণা ছিল। 

যথারীতি মাকে নিয়ে পৌঁছায় কলকাতার ঠাকুরপুকুরে, সরোজ গুপ্ত ক্যানসার সেন্টার অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটে। জায়গাটি বেহালার পাশে। ইন্ডিয়ান ক্রিকেটের একসময়ের সফল অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলির বাড়ি বেহালায়। যাহোক। মা তখন পর্যন্ত জানত না তার ক্যানসার সম্পর্কে। তাকে জানানো হয়েছিল, ছোট্ট একটি টিউমার ধরা পড়েছে। পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়ার জন্যই ইন্ডিয়া যাওয়া। বার ছিল শনিবার। সেদিন অর্ধ দিবস এবং পরদিন রবিবার বন্ধ। পৌঁছাতে দুপুর পার হয়ে গিয়েছিল। অগত্যা সোমবার পর্যন্ত অপেক্ষা। ক্যানসার সেন্টারের পাশেই ‘অমরাবতী’ নামে এক গেস্ট হাউসে উঠলাম। এক রুমের ভাড়া প্রতিদিন ১৭০ রুপি। বলা ভালো, রুমে থাকার ব্যাপারে সংখ্যার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। মাথায় দুশ্চিন্তা নিয়ে ঘোরাফেরা করা যায় না। তাই বিকেলের দিকে ক্যানসার সেন্টারের পাশেই ঘুরতে বের হওয়া। দেখলাম ক্যানসার সেন্টারকে কেন্দ্র করে অনেকগুলোই গেস্ট হাউস গড়ে উঠেছে রোগীদের জন্য। তবে ওইসব গেস্ট হাউসে রোগী ছাড়া সাধারণ মানুষ থাকার নিয়ম নেই। ‘অনলি ফর পেশেন্ট পার্টি’। 

সোমবার অর্থাৎ ২৭ অক্টোবর ভোর ৭টার দিকেই ছুটলাম ক্যানসার সেন্টারে, লাইন দেবার জন্য। আগেই জেনেছিলাম, ফরম পূরণের কাউন্টার খুলে সকাল ৯টার দিকে; কিন্তু সাধারণ মানুষ সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে ভোর ৭টার পর থেকেই। ক্যানসার সেন্টারে গিয়ে দেখি, আমার আগেও অনেক মানুষ এসে পৌঁছে গেছে। লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ি। এরপর মাথা খারাপ হবারই জোগাড়! শুধু আমরাই নই, শয়ে শয়ে বাংলাদেশী। এত বেশি দেশী মানুষকে দেখতে পাবো, তা কখনোই ভাবিনি। আর আমরা যারা বাংলাদেশী, তাদের একটা অভ্যাস ছিল; সেটা হলো— ‘কোথা থেকে আসছেন?’ এভাবেই পরিচয়টা জেনে যাওয়া। 

যে কাউন্টারের সামনে আমরা লাইনে দাঁড়িয়েছিলাম, সেটি ছিল শুধু নতুন রোগীদের জন্য। দেশী-বিদেশী সবার জন্য। উল্লেখ্য, সরোজ গুপ্ত ক্যানসার সেন্টারে আলাদা করে কোনো ফরেন ডেস্ক নেই। তাই আমরা যারা বাংলাদেশী তাদের জন্য একটু সমস্যাই বটে। আলাদা ডেস্ক থাকলে সুবিধা হতো। যাহোক লাইনে দাঁড়ানো বাংলাদেশীদের মধ্যে রাজশাহী, রংপুর ও খুলনা বিভাগের মানুষজনই বেশি। চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ফেনীর মানুষের সঙ্গেও দেখা হয়েছিল, তবে পরে।

(বাকি অংশ আগামী রবিবার)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন