দৈনিক চাঁপাই চিত্র, চাঁপাইনবাবগঞ্জ; ২২ জানুয়ারি ২০১৫
স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল এসএ টিভির চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছেন আহসান হাবীব। কর্মস্থল জেলা হলেও বাড়ি শিবগঞ্জ উপজেলায়। প্রায়শই ফোনে কথা হয় তার সঙ্গে, সেখানকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে। আলাপচারিতার সময়কাল নিদেনপক্ষে মিনিট দশেকের কম নয়। কিন্তু গত ৫ জানুয়ারির পর থেকে সে আলাপে ভাটা পড়ে; মিনিটখানেকও অতিক্রম হয় না। কারণ একটাই— শিবগঞ্জের উত্তপ্ত পরিস্থিতি। সেখানে বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন স্থানে ঘটনা ঘটতেই আছে। কোন দিকে যাবেন, কোন ঘটনাটিকে গুরুত্ব দেবেন— এসব স্থির করতে তিনিসহ জেলার সব সাংবাদিকের অবস্থা এখন চরমে। ওদিকে অফিস থেকে একের পর এক অ্যাসাইনমেন্ট। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো সক্রিয় হওয়ার দরুন বর্তমানে যেকোনো খবর এখন মিডিয়ায় প্রকাশ হওয়ার আগে এসব মাধ্যমে দেশসহ বাইরেও ছড়িয়ে পড়ছে। আর এসব মাধ্যমে খবর জানতে পেরে বার্তা সম্পাদকও তার প্রতিনিধিদের অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে তটস্থ রাখছেন। আর তাই জেলার মধ্যে এ মুহূর্তে সবচেয়ে চাপ এবং দৌড়ের মাঝে আছেন শিবগঞ্জ উপজেলার সাংবাদিকরা। মুক্ত নেই জেলা প্রতিনিধিরাও। যাই হোক, কোনো ঘটনাই তো আর বাদ দেয়া যায় না।
কানসাট পল্লী বিদ্যুতের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শুরু শিবগঞ্জের পরিস্থিতি উত্তপ্ত হওয়া। তার আগেও হয়েছে, তবে তা বিচ্ছিন্নভাবে। যাহোক শিবগঞ্জের উত্তপ্ত পরিস্থিতি আজও চলমান। জামায়াত অধ্যুষিত হওয়ায় সেখানকার রাজনীতি বা উপজেলাটি গত ১০ বছরে কোনো একটি বছরও শান্তিময়ভাবে পার হতে পারেনি। প্রশ্ন হচ্ছে, শিবগঞ্জ কি কোনো ভিনগ্রহের দেশ? তা না হলে সেখানকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভবপর হচ্ছে না কেন? এর আগেও শিবগঞ্জে যৌথ বাহিনীর অভিযান চলার খবর আমরা মিডিয়ার মাধ্যমে জানতে পেরেছি। কিন্তু পরিস্থিতির উন্নতি চোখে পড়েনি। এর কারণ অবশ্যই খুঁজে বের করতে হবে। যেখানে দেশের প্রধান বিরোধী বা বড় রাজনৈতিক দল বিএনপিকে নাশকতার আশঙ্কায় রাজধানী ঢাকায় যেকোনো ধরনের সভা-সমাবেশ, মিছিল-মিটিং থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিরত রাখতে পেরেছে, সেখানে শিবগঞ্জ উপজেলায় সম্ভব হচ্ছে না কেন? এর জন্য কি শিবগঞ্জে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রয়োজনীয় জনবলের অভাব দায়ী? নাকি অন্য কিছু! মূল কারণ যাই হোক, তা খুঁজে বের করার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঘাড়েই বর্তায়।
চাঁপাই চিত্রে তিন মাস আগে অর্থাৎ ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৪ তারিখে প্রকাশিত সংখ্যার প্রধান খবরই ছিল শিবগঞ্জের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে। শিবগঞ্জ প্রতিনিধি শহিদুল ইসলাম খোকনের প্রতিবেদনটিতে সে সময়কার জেলা পুলিশ সুপার বশির আহম্মেদের উদ্ধৃতি ছিল এ নিয়ে। তিনি বলেছিলেন, ‘... শ্যামপুর এলাকায় স্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প এবং ধোবড়া এলাকায় আরো একটি পুলিশ তদন্ত কেন্দ্র নির্মাণসহ কানসাটে স্থায়ী হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ি করার জন্য ৭-৮ মাস আগে একটি প্রস্তাবনা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এটি অনুমোদন হলে শিবগঞ্জ উপজেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সার্বিক উন্নতি ঘটবে।’
বশির আহম্মেদের বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করতেই হয়। কেননা শিবগঞ্জ একটি বড় উপজেলা। সামান্য জনবল দিয়ে এ উপজেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। প্রয়োজন বাড়তি জনবল। তদুপরি এটি ভারতীয় সীমান্ত ঘেঁষা এবং জামায়াত অধ্যুষিত। এ উপজেলার জঙ্গি নেটওয়ার্ক নিয়ে দেশীয়সহ ভারতীয় পত্রপত্রিকায় বিস্তর প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে। দেশের অন্যান্য জেলাসহ চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার জঙ্গি নেটওয়ার্কের খেঁাজখবর নিতে ভারতীয় জাতীয় তদন্ত সংস্থার (এনআইএ) একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ ঘুরেও গেছে। আর জেলা সদরের চেয়ে বর্তমানে শিবগঞ্জে জামায়াতের প্রভাব বেশিমাত্রায় বেড়েছে বৈ কমেনি।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো প্রস্তাবনার আলোকে কোনো উদ্যোগ বা এর বাস্তবায়ন করা হয়েছে কিনা সে সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়। কেননা অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর— এ তিন মাসে অধিকাংশ সময়ই থাকা হয়েছে দেশের বাইরে। তাই এ-সংক্রান্ত কোনো খবর প্রকাশ হয়ে থাকলেও তা নজরে আসেনি। যদি বাস্তবায়ন না হয়ে থাকে তবে ত্বরিত ব্যবস্থা নেয়া দরকার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। আর যদি বাস্তবায়ন হওয়ার পরও শিবগঞ্জের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না, তাহলে এ উপজেলার পরিস্থিতি নিয়ে গুরুত্বসহকারে নতুন করে ভাবতে হবে। কেননা এ ধরনের পরিস্থিতি যত বেশি স্থায়ী হবে, ততই সমাজের জন্য অমঙ্গল বয়ে আনবে। তবে শিবগঞ্জের পরিস্থিতি মোকাবিলায় কানসাট ও শাহবাজপুরে দুটি পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে (চাঁপাই চিত্র, ২০ জানুয়ারি)।
শিবগঞ্জের বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটাতে না পারলে ভবিষ্যতে সামাজিকভাবে দাঙ্গা-ফ্যাসাদ রোজকার নিয়মে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। কারণ, এসব পরিস্থিতির জন্য তখন সামাজিকভাবে একে অন্যকে দায়ী করার প্রবণতা বাড়বে। আর সে প্রবণতা থেকে একে অন্যের মধ্যে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা মোটেও উড়িয়ে দেয়ার নয়।
ভারতীয় সীমান্ত ঘেঁষা হওয়ার দরুন এ উপজেলায় অপরাধ সংঘটিত হওয়ার মাত্রাটাও বেশি। কাজেই শক্তভাবে তা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে সেখানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুরোদমে ভেঙে পড়তে পারে এবং তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। আমরা চাই না, তা ঘটুক।
রাজনৈতিক সহিংসতার বর্বরচিত্র শিবগঞ্জবাসী এর আগেও প্রত্যক্ষ করেছে। পরিসংখ্যান টেনে লেখার পরিধি বাড়াতে চাচ্ছি না। শুধু শিবগঞ্জ নয়, পুরো জেলাবাসীই সেসব খবর জানেন মিডিয়ার কল্যাণে। বর্বরতার দুটি ঘটনা শুধু এখানে উল্লেখ করব। একটি ২০১৩ সালের ডিসেম্বরের ঘটনা। শিবগঞ্জ বাজারে পৌর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা ও শিবগঞ্জ শিল্প-বণিক সমিতির সভাপতি এনামুল হকের দোকান দুবৃর্ত্তরা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিল। সে আগুনে পুড়ে মারা গিয়েছিলেন দোকানে থাকা এনামুল হক। সর্বশেষ বলি হলো নবম শ্রেণীর ছাত্র— রাজন আলী রকি। গত ১৫ জানুয়ারি স্কুল থেকে ফেরার পথে জামায়াত-শিবির কর্মীরা তাকে নির্মমভাবে পেটায়। মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে পরদিন শুক্রবার রাতে রকি মারা যায়। বাবা আওয়ামী লীগ করায় রকি এ হত্যাকাণ্ডের শিকার বলে দাবি করেছেন নিহতের ভাই। যদিও এ ঘটনা শিবগঞ্জ উপজেলা জামায়াতের নায়েবে আমির তা অস্বীকার করেছেন। উল্লেখ্য, এই রকির বাড়িতেই এক বছর আগে দুবৃর্ত্তরা আগুন দিয়েছিল। সে আগুন আতঙ্কে রকি গত এক বছর তার চাচার বাড়িতেই ঘুমিয়েছে, যার তার বাড়ি থেকে জানা গেছে।
স্বীকার বা অস্বীকার— বড় বিষয় নয়। বড় বিষয় হচ্ছে দেশের রাজনীতি কতটা অপরাজনীতিতে পরিণত হলে এরকম ঘটনা ঘটতে পারে। তবে এ নির্মম ঘটনার ঘৃণা জানানোর ভাষাও আর অবশিষ্ট নেই। কেননা প্রতিনিয়ত হরহামেশাই এখন এ ধরনের নির্মমতার শিকার হচ্ছে অনেকেই। টানা ১২ দিনের অবরোধে দেশের অন্যত্রও দুবৃর্ত্তদের ছোড়া পেট্রলবোমার আঘাতে দগ্ধ হয়েছে অনেক শিশু, মারাও গেছে। তাদের অপরাধ কী ছিল? কেউ কি তার উত্তর দিতে পারবেন? সম্ভবত, না।
১৮ জানুয়ারি খবরটি দেখে মনটা নিদারুণ খারাপ হয়েছে। শুধু আমার নয়, অনেকেরই মন খারাপ হবে এ ধরনের খবর পড়ে। এর কি কোনোই পরিত্রাণ নেই? থাকলে কবে? এ প্রশ্নগুলো নিশ্চয়ই শিবগঞ্জ উপজেলাবাসীর মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। আর আশায় দিন গুনছে— কবে শান্ত হবে তাদের শিবগঞ্জ?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন