দৈনিক চাঁপাই চিত্র, চাঁপাইনবাবগঞ্জ; ১৮ আগস্ট ২০১৫
দেশ এগিয়েছে, মানুষ এগিয়েছে— সত্যিকার অর্থেই এগিয়েছে। ইতিবাচক হোক আর নেতিবাচক হোক— এক অর্থে এগিয়েছে, এগোতেই আছে। টু-জির বদলে থ্রি-জিতে কনভার্ট হয়েছে। পুরোপুরি কভারেজ না পেলেও ব্যবহারকারী থ্রি-জির বিল ঠিকই পরিশোধ করতে শিখেছে! সাধারণ কলের পরিবর্তে ভিডিও কল করতে শিখেছে। বিদেশে ফোন করতে স্কাইপি, ভাইবার, ট্যাঙ্গো ... আর কতো মাধ্যম ব্যবহার করতে শিখেছে! প্রতিনিয়ত শিখতেই আছে, এগোতেই আছে। সাধারণ ফোন সেট ছেড়ে অ্যান্ড্রয়েড সেট ব্যবহার করতে শিখেছে। সেলফোন কোম্পানিগুলোর অফার বেড়েছে। বাহারি অফার, নানারকম অফার। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, অফারের তালিকা তাবিজ বানিয়ে গলায় ঝুলিয়ে সেলফোন ব্যবহার করতে হবে! বলতে গেলে অফারের বন্যায় ভাসছে এ দেশ। অন্যান্য কোম্পানির ছাড়ের বন্যা তো আছেই!
বলা হয়, শেখার শেষ নেই। শেষ নেই দেখারও। তাই দেখতেই আছে, শিখতেই আছে। সাধারণ প্রশ্ন ছেড়ে সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর দিতে শিখেছে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ছেড়ে কিন্ডারগার্টেন স্কুলে বাচ্চাদের পড়ানো হচ্ছে। এতেও মনে শান্তি না এলে ইংলিশ মিডিয়ামে ভর্তি করানো হচ্ছে। কী শিখছে, কী শেখাচ্ছে— এসবের বালাই নেই। চাই ভালো ফলাফল, সে যেকোনো প্রকারেই হোক। আর তাই ক্লাস টু’র সাধারণ জ্ঞানে চাকরিতে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নও থাকছে! (দেশের কিন্ডারগার্টেনগুলো যেসব সাধারণ জ্ঞানের বই পড়ায়, সেগুলো দেখার জন্য সবার প্রতি অনুরোধ রইল।) চলছে কমপিটিশন। বাদ নেই অভিভাবকরাও। স্কুলের ছাউনিতে বসেও তাদের কমপিটিশন— কার বাচ্চা কোন কোন বিষয়ে কত ভালো; কার বাচ্চা কোন কোন খেলায় এক্সপার্ট; কার বাচ্চা কী খেতে পছন্দ করে, কী খেতে পছন্দ করে না। ‘জানেন তো, আমার বাচ্চা ... ছাড়া অন্য কিছু খেতেই চায় না।’ ছেলেমেয়েরা এখন শহরমুখী হয়েছে। প্রতিটি সাবজেক্টে প্রাইভেট পড়তে শিখেছে। বাদ থাকে না ইতিহাস বিষয়ও! কমপিটিশন ছাড়া এখন টেকাই দায়! এখন শিক্ষা ব্যবস্থা বদলেছে। খাতা-কলমের বদলে ল্যাপটপে ক্লাস হচ্ছে। ক্লাসে শিক্ষকের বদলে ভিডিওর মাধ্যমে পাঠদান চলছে। ‘স্টার মার্ক’ কিংবা ‘বোর্ড স্ট্যান্ডে’র বদলে গোল্ডেন প্লাস এসেছে। পাসের হার বেড়েছে। মেধাবীর সংখ্যাও বেড়েছে। কিন্তু মান বেড়েছে? ওই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণের সংখ্যাও কমছে। ভর্তি পরীক্ষার পদ্ধতিই গলদ, এখন তাই বলা হচ্ছে!
দেশ এগিয়েছে, ভালোভাবেই এগিয়েছে। সাধারণ মানুষের সাহস বেড়েছে। শিশুহত্যা বেড়েছে। বন্দুক কিংবা ধারালো অস্ত্র নয়— মলদ্বারে হাওয়া মেশিনের পাইপ ঢুকিয়ে শিশুহত্যা করতে শিখেছে। মৃত্যুভয় আছে জেনেও সমুদ্রপথে সাধারণ নৌকোয় বিদেশে পাড়ি দিতে শিখেছে। কী কারণে এই পাড়ি? অভাব নাকি বিলাসিতা? উত্তর নেই। উত্তর খোঁজার চেষ্টাও নেই। প্রশ্ন অনেক আছে। উত্তর নেই। তাই বিদেশে তেলের দাম কমতে থাকলেও দেশে তেলের দাম কী কারণে কমে না, তার উত্তরও জানা নেই। এভাবেই চলতে আছে, চলতেই থাকবে। সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠলে কারোরই অসুবিধা নেই। সেতু পার হতে সাইকেল চালককে টোল দেয়ার সিদ্ধান্ত হলেও তাই অবাক হওয়ার জো নেই।
এগোচ্ছে, সবকিছুই ঠিকঠাক এগোচ্ছে। পরিষেবা না পেলেও দেশে পৌরসভার সংখ্যা বেড়েছে। চেয়ারম্যান, মেয়র, কাউন্সিলর, মেম্বারদের আয় বেড়েছে। নাগরিক সুবিধা না বাড়লেও হোল্ডিং ট্যাক্স বেড়েছে। সড়ক বাতি ‘সুইচ অনে’র অপেক্ষায় আজও জ্বলা থেকে বিরত থাকছে। ড্রেন এখন ‘রাস্তার ওপর দিয়ে’ (বি. দ্র. অধিকাংশ স্থানে রাস্তার ওপর আশপাশের ঘরবাড়ির পানি নিষ্কাশন হতে দেখা যায়) নির্মিত হয়েছে। ডিজিটাইল সাইনের দৌরাত্ম্যে দিবসে দিবসে গ্রামে-গঞ্জে নেতাকর্মীদের শুভেচ্ছার বাহার বেড়েছে। বাদ যাচ্ছে না ব্যবসায়ীরা। দলে নাম ভেড়াতে তাই নতুন মাধ্যম ‘ডিজিটাল ব্যানারে’ ছবিসহ বাণী ছাপছে। উন্নয়নের জিকির তুলছে। আগামী নির্বাচনে দাঁড়ানোর উঁকি দিচ্ছে।
এগিয়েছে, সবকিছুই এগিয়েছে। চিকিৎসা ব্যবস্থাও এগিয়েছে। সরকারি হাসপাতালগুলো আধুনিক হয়েছে। শয্যার সংখ্যা বেড়েছে। আনাচে-কানাচে ব্যাঙের ছাতার মতো ক্লিনিকও গজিয়েছে। গ্রাম্য হাতুড়ে ডাক্তারের পরিবর্তে এখন ক্লিনিকগুলোয় প্রসূতির মৃতের সংখ্যা বেড়েও চলেছে। এরা প্রসূতির মৃত্যুর দায় সারে ২০-৫০ হাজার টাকায়। পত্রিকার পাতা উল্টালেই এর সত্যতা চোখেও পড়ছে। ক্লিনিকগুলো কীভাবে চলছে, এমবিবিএস পাস করা চিকিৎসক সার্বক্ষণিক বসছেন কিনা, নিয়মমাফিক চলছে কিনা— এসবের কোনো তদারকি নেই। চিকিৎসকের ভিজিট বেড়েছে। পরদিন রিপোর্ট দেখাতে গেলেও রোগীরা টাকাও গুনতে শিখেছে। প্রতিদিন গেলে, প্রতিদিন টাকা দাও— নতুন নিয়ম চালু হয়েছে। প্রতিবাদেরও ভাষা নেই! প্রতিবাদ করলেই যে চিকিৎসা ধর্মঘট! সাহস কার? হারবাল মেডিসিনের বিলবোর্ডের দৌরাত্ম্য বেড়েছে। গলি-ঘুপচিতে হারবাল চিকিৎসা কেন্দ্রের সংখ্যা বেড়েছে। ক্যাবল অপারেটরের মাধ্যমে এদের বিজ্ঞাপনের আধিক্যও বেড়েছে। অন্য কোনো রোগ সারতে না পারলেও ‘যৌন’ ও ‘গোপন’ রোগের চিকিৎসা এদের কাছে আছেই?
মানুষ এখন সচেতন হতে শিখেছে। হয়রানির ভয় থাকা সত্ত্বেও মোটরসাইকেলের রেজিস্ট্রেশন করতে শিখেছে। ড্রাইভিং লাইসেন্স করার জন্য ভোগান্তি বেড়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন দিন দিন সরব হয়ে উঠছে। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের চতুর্থ শ্রেণির কোটিপতি কর্মচারীকে তলব করেছে। অবৈধ আয়ের উৎস খুঁজতে তারা সচেষ্ট হয়েছে। বিকল্প ব্যবস্থা তৈরি না হলেও মহাসড়ক থেকে নসিমন, করিমন, অটোরিকশা চলাচল বন্ধ হয়েছে। দেশ এগিয়েছে, অবশ্যই এগিয়েছে। ধানি জমি উজাড় হয়ে আমবাগান গড়ে উঠছে। পুকুর, দীঘি, খাল-বিল ভরাট করে বসবাসের ‘আধুনিক নগরী’ গড়ে উঠছে। গ্রামে-গঞ্জেও এখন ‘প্লট আকারে জমি বিক্রি চলছে’-সর্বস্ব সাইনবোর্ড চোখে পড়ছে। মফস্বলের ছেলেরাও ইন্টারনেটে পর্নো ইমেজ বা মুভি দেখতে শিখেছে।
দেশ এগিয়েছে। বাঘের গর্জন বেড়েছে। ক্রিকেট খেলার মাঠে বাংলাদেশের টাইগাররা পাকিস্তান, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকাকে সিরিজ বধ করেছে। হারের ভয়ে অস্ট্রেলিয়া টাইগারদের সঙ্গে ওয়ানডে খেলতে ভয় পাচ্ছে! তাই তো টেস্ট সিরিজ খেলেই খালাস হতে চাচ্ছে তারা।
দেশ এগিয়েছে। অবশ্যই এগিয়েছে। আনাচে-কানাচে কাঁচা রাস্তা বদলে পাকা হয়েছে। নদীতে নদীতে সেতু গড়ে উঠেছে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু করার সাহস দেখিয়েছে। বিদ্যুতের মাত্রাতিরিক্ত লোডশেডিং কমেছে। তথ্যপ্রযুক্তির প্রতি মানুষের আকাক্সক্ষা-চাহিদা বেড়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ঝরে পড়ার সংখ্যা কমেছে। সর্বোপরি ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িতদের বিচার হচ্ছে। আরো আছে। থাক সেগুলোর কথা। বদলে বা এগিয়ে যাওয়ার গল্প লিখে শেষ করা যাবে না। তবুও তো প্রশ্ন থেকে যায়? সাধারণ মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো কি পুরোপুরি পূরণ হচ্ছে— সে প্রশ্ন বরাবরই নীরবে পথ হাতড়ে বেড়ায়। আবারো অপেক্ষা, এসব প্রশ্নের উত্তর জানবার। কারণ, সাধারণ মানুষ জানে শুধুই অপেক্ষা করতে— ভালো দিনের প্রত্যাশায়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন