৫ জানুয়ারি, ২০১৫। এ দিন আওয়ামী লীগ সারা দেশে গণতন্ত্র রক্ষা দিবস পালন করেছে। গত বছরের এ দিনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। যদিও সে নির্বাচন নিয়ে অনেক তর্ক-বিতর্ক এখনো জারি রয়েছে। আলোচনার বিষয় সেটি নয়। জেলা বা নিজ এলাকার রাজনীতির ওপর আলোচনার জন্যই উপরোক্ত শিরোনামের সূত্রপাত। তবে লক্ষণীয় যে, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর কোনো খবর বা প্রতিবেদন স্থানীয় পত্রিকাগুলোয় খুব কমই চোখে পড়েছে। যেটুকু পড়েছে, তা হলো মিছিল-মিটিং-সভা-সেমিনার সংক্রান্ত। তাই আলোচনার জন্য শুধু নিজ এলাকা নাচোলকেই বেছে নেয়া হয়েছে।
নাচোল-গোমস্তাপুর-ভোলাহাট উপজেলা নিয়ে গঠিত চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ সংসদীয় আসন। এ আসনে এবারে জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন গোমস্তাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা মরহুম খালেক বিশ্বাসের সন্তান গোলাম মোস্তফা বিশ্বাস। ৫ জানুয়ারি তিনি ব্যস্ত দিনই পার করেছেন এবং তা খুবই স্বাভাবিক। দলের নেতাকর্মীর চাওয়া-পাওয়া ও প্রত্যাশা পূরণ এবং তিনটি উপজেলায় একই দিনে দৌড়ঝাঁপ নিঃসন্দেহে ক্লান্তিকর, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ওই দিন তিনি শেষ বিজয় মিছিল এবং পথসভা করেন নাচোল উপজেলায়, সন্ধ্যার সময় এবং তা নাচোল পৌর আওয়ামী লীগের ব্যানারে। বাসস্ট্যান্ড মোড়ে পথসভায় তিনি সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন। তার বক্তব্যের মধ্যে যাওয়ার আগে অন্য একটি বিষয় উল্লেখ করা দরকার। বলাবাহুল্য, ওই দিন সকালে নাচোল উপজেলা আওয়ামী লীগ, যুবলীগের উদ্যোগে গণতন্ত্র রক্ষা দিবস ও বিজয় মিছিল বের করা হয়। যার নেতৃত্বে ছিলেন নাচোল উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল কাদের, উপজেলা যুবলীগের সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান মজিবুর রহমানসহ অন্য নেতারা।
এলাকায় স্থায়ী হওয়ার পর থেকেই নাচোল উপজেলা আওয়ামী লীগের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের খবর বিভিন্ন মাধ্যমে জানতে পেরেছি। এ নিয়ে অনেক কানাঘুঁষা এলাকায় চলেছে। তাহলো সংসদ সদস্য গোলাম মোস্তফা বিশ্বাস নাচোল উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আবদুল কাদের এবং তার সমর্থিতদের এড়িয়ে চলছেন। আবার সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব রয়েছে সভাপতি আবু বাক্কার সিদ্দিকের সঙ্গে। সংসদ সদস্য ঝুঁকেছেন সভাপতির দিকেই। আবদুল কাদের সমর্থিতদের অপরাধ, তারা নাকি জিয়াউর রহমানের (গত সংসদের এ আসনের সংসদ সদস্য) লোক ছিলেন। এসবই কানাঘুঁষা বা অপ্রত্যক্ষ খবর। এর বাস্তবতা একমাত্র দলই ভালো বলতে পারবে।
তবে এ অপ্রত্যক্ষ গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব প্রকাশ্যেই এসেছে ৫ জানুয়ারি। তা নিশ্চয়ই দুই পক্ষের কেউই অস্বীকার করতে পারবে না। বরং বেশি মাত্রায় প্রকাশ্যে এসেছে ৫ জানুয়ারি নাচোলের পথসভায় সংসদ সদস্য গোলাম মোস্তফা বিশ্বাসের বক্তব্যে। ওই দিন বক্তব্য দেয়ার সময় তার হাতে পাশ থেকে একটি চিরকুট ধরিয়ে দেয়া হয়। চিরকুটের রেশ ধরে তিনি যা বললেন, তা হলোÑ ‘আমি এই চিরকুটের বক্তব্য এখানে তুলে ধরব না। সময় হলেই আলোচনা হবে। তবে এটুকু বলতে পারি, ব্যক্তির চেয়ে দল বড় এবং দলের চেয়ে দেশ বড়।’
চিরকুটে আদৌ কী লেখা ছিল, তা জানা সম্ভব হয়নি। তবে সংসদ সদস্যের এ বক্তব্যের ভিত্তিতে এটুকু সবাই অনুমান করবেন যে, সকালে উপজেলা আওয়ামী লীগের কর্মসূচি পালনের বিষয়টিই চিরকুটে উল্লেখ ছিল। তবে একই দিনে একই দলের ভিন্ন সময়ে কর্মসূচি শুধু সাধারণ মানুষ নয়, নিজ দলীয় নেতাকর্মীর অনেকের কাছেই দৃষ্টিকটু লেগেছে, তা জোর দিয়ে বলা যায়। আর সংসদ সদস্যের এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে প্রকাশ্য হলো, নাচোল উপজেলা আওয়ামী লীগের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। যদিও এ দ্বন্দ্বের কারণেই উপজেলা আওয়ামী লীগের কাউন্সিল এখনো অনুষ্ঠিত হয়নি। মাঝে একবার কাউন্সিল করার বিষয়ে চিঠি বিতরণ হলেও তা কেন্দ্রীয় নির্দেশে স্থগিত হয়। ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, গোলাম মোস্তফা বিশ্বাস এ চিরকুটের আলোকে কোনো বক্তব্য না দিয়ে চুপচাপ থাকলেই বোধহয় অপ্রকাশ্য দ্বন্দ্বটা প্রকাশ্যে আসত না। যাক, উনি জনপ্রতিনিধি। আমাদের চেয়ে ভালো-মন্দ বুঝবার ঢের ক্ষমতা রয়েছে তার। আমরা শুধু নিজেদের ভালো বা মন্দ লাগাটা একে অন্যের সঙ্গে বিনিময় করতে পারি।
দেশের প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলেই গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব রয়েছে এবং এটি তৃণমূল পর্যন্ত প্রসারিত। ঢাকায় এক কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে আলাপকালে মজা করে তিনি বলেছিলেন, ‘দলে দ্বন্দ্ব থাকা ভালো। তাতে কর্মী বাড়ে।’ হয়তো তার কথাটা একদিক দিয়ে ঠিক। তবে এর কোনো ভিত্তি আছে বলে মনে হয় না। তবে দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব সাধারণত বেশি মাথাচাড়া দেয় দল ক্ষমতায় থাকার সময়। ক্ষমতার মোহাচ্ছন্নে অধিকাংশ সময় অনেক নেতাকর্মী তখন ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন, যা দলের ক্ষতি ছাড়া অন্য কিছুই করে না। গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব শুধু নিজ দলেরই ক্ষতি করে না। ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাধারণ মানুষও। ক্ষতি হয় এলাকার উন্নয়ন কর্মসূচির কাজও।
কেননা নেতাকর্মী বা সাধারণ মানুষ নিজ এলাকার উন্নয়নের জন্য সংসদ সদস্য বা জনপ্রতিনিধির কাছেই যান বা তাকে গিয়ে ধরেন। কিন্তু অধিকাংশ সময় তাদের এ দাবি-দাওয়া গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে চাপা পড়ে যায়। তখন বিবেচনা করা হয়, ‘ও তো ওই পক্ষের লোক’ কিংবা ‘তারা তো ওই পক্ষে ছিল’। এ দৃশ্য শুধু সংসদ সদস্যের ক্ষেত্রেই নয়, ওয়ার্ড থেকে শুরু পৌরসভা, উপজেলা পরিষদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। সর্বত্রই একই দৃশ্য বিরাজমান। ব্যক্তির রদবদল হয়, কিন্তু স্বার্থের দ্বন্দ্বটা সবসময় থেকেই যায়। এ থেকে উত্তরণ অবশ্যই প্রয়োজন। তার জন্য জনপ্রতিনিধিদেরই দায়িত্ব নিতে হবে এবং তাদেরই এগিয়ে আসতে হবে। একমাত্র তারাই পারেন সে আস্থার জায়গাটা তৈরি করতে। মনে রাখতে হবে, জনপ্রতিনিধি শুধু দলেরই নন; তিনি সাধারণ মানুষেরও প্রতিনিধি। সর্বাগ্রে এ বিবেচনা বোধটায় রাখতে হবে সব প্রতিনিধিকে। কেউ শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে তার বিরুদ্ধে দলীয় ব্যবস্থা নেয়াটাই গ্রহণযোগ্য। তার জন্য পক্ষ তৈরির প্রয়োজন হয় না। রাজনীতিতে সবাইকে পাশে রাখতে হবে। এতে যেমন দলও উপকৃত হয়, সাধারণ মানুষও তেমন আশান্বিত হয়। আর সমন্বিতভাবে কাজ করলে সামগ্রিকভাবে দেশই উপকৃত হয়। উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে আবদুল কাদেরও একজন জনপ্রতিনিধি। তার চেয়েও বড় জনপ্রতিনিধি সংসদ সদস্য গোলাম মোস্তফা বিশ্বাস। দুজনেরই মিল একটি জায়গায়, তা হলোÑ তারা দুজনেই একই দলের লোক। একজন সংসদ সদস্য হিসেবে গোলাম মোস্তফা বিশ্বাসের যে সম্মান প্রাপ্য তা যেমন আবদুল কাদেরকে দিতে হবে। অনুরূপভাবে তাকেও। দুজনেই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করলে এলাকাবাসী যেমন উপকৃত হবে, তেমনি দল তথা নেতাকর্মীর মনোবলও চাঙ্গা হবে বলে বিশ্বাস। আশা করব, তারা এ পথেই হাঁটবেন।
কোনো উন্নয়ন কর্মসূচি দলের হতে পারে না। পারে না কোনো গোষ্ঠীর কর্মসূচি হতে। তা হতে হবে সাধারণ মানুষের জন্যই। কাজেই গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে যেন চাপা না পড়ে সাধারণ মানুষের চাওয়া-পাওয়া কিংবা প্রত্যাশাÑ সেটা সংসদ সদস্য তথা সব জনপ্রতিনিধিকেই খেয়াল রাখতে হবে। সংসদ সদস্য গোলাম মোস্তফা বিশ্বাসের দেয়া বক্তব্য ধর্তব্যে নিয়ে বলতে হয়, ‘ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়।’ আর দেশ গঠনের প্রধান উপাদানই হলো তার জনগণ। সে জনগণের ভোটেই তারা নির্বাচিত হন। কাজেই তাদের উপেক্ষা করার অর্থই হলো পরের বার নতুন মুখ, নতুন মানুষ। জনগণের কাছে অন্য কোনো ক্ষমতা না থাকলেও এই একটি ক্ষমতাই সে পাঁচ বছর পর পর প্রয়োগ করতে পারে। এ সত্যটি মেনেই তাদের সামনে এগোতে হবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন