মঙ্গলবার, ১৩ জুলাই, ২০২১

তেজগাঁও ছাড়ছেন শিল্পপতিরা


১৬ জুলাই, ২০১১


সব ভালো কাজ যেমন প্রশংসার যোগ্য, তেমনি একজন রিপোর্টারের একটি ভালো রিপোর্টও প্রশংসার দাবি রাখে। ২ জুলাই বণিক বার্তায় প্রকাশিত ‘তেজগাঁও ছাড়ছেন শিল্পপতিরা’ তেমনই প্রশংসার দাবি রাখে। তবে রিপোর্টটিতে শ্রমিকদের কথা, বিস্তারিত উঠে আসার প্রয়োজন ছিল। প্রকাশিত খবরটি পড়ে আমার একটা বিষয় মনে হলোÑ দেশের শিল্পমালিকরাও ক্ষমতার কাছে অসহায় হয়ে থাকছেন। কেননা যেসব কারণে শিল্পমালিকরা দেশের অন্যতম প্রাচীন শিল্পাঞ্চল তেজগাঁও ছেড়ে যেতে চাচ্ছেন, তার

সমাধানের কোনো উদ্যোগ গত সাড়ে দশ বছরে নেয়া হয়নি। প্রশাসন কিংবা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ও এ ব্যাপারে খুব একটা তৎপর নয়। একটি জাতীয় দৈনিকে এ ধরনের একটি খবর প্রকাশের পর সংশ্লিষ্ট সবার তৎপর হয়ে ওঠার কথা; কিন্তু তা যে হয়নি সেটা তো স্পষ্ট। কারণ প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর দীর্ঘদিন দিন অতিবাহিত হয়েছে অথচ বণিক বার্তায় এ-সংক্রান্ত কোনো ফলোআপ চোখে পড়েনি।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ১০ থেকে ১৫ বছরে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলে ১০টির বেশি শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, প্রকাশিত খবরে কিন্তু ‘বন্ধ’ হওয়ার কথাই বলা হয়েছে। স্থানান্তরিত হয়েছে, তা বলা হয়নি। যদি ধরে নিই যে, ১৭টি শিল্পকারখানা বন্ধ হয়েছে, তা হলে এর সঙ্গে বেকার হয়েছে কমবেশি ১৭ হাজার শ্রমিক। আর অনিশ্চিত জীবনের মধ্যে পড়েছে প্রত্যেক শ্রমিকের পরিবারে গড়ে পাঁচজন সদস্য ধরলে অন্তত ৮৫ হাজার মানুষ। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, যেসব সমস্যার কারণে এসব শিল্পকারখানা বন্ধ হয়েছে, তা ছিল সহজেই সমাধানযোগ্য। আমাদের দুর্ভাগ্য এই যে, যারা শিল্প-বাণিজ্যের মাধ্যমে দেশটাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে চান, তারাই প্রশাসনের অসহযোগিতার দরুন এবং চরম অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির কারণে ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হন। একে দুর্ভাগ্য ছাড়া কিইবা বলা যায়! কারণ হিসেবে প্রথমে বলা হয়েছে- অবকাঠামোগত সমস্যা ও পরিবেশের চরম অবনতি। পরে বলা হয়েছে- গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকট; জলাবদ্ধতা সমস্যা এবং মাদকসেবীদের দৌরাÍ্য। জলাবদ্ধতা এবং মাদকসেবীদের দৌরাÍ্যরে কারণে বিদেশী ক্রেতারা যেমন তেজগাঁও এলাকায় যেতে চান না, তেমনি শ্রমিকরাও কারখানায় কাজ করতে চান না বলে প্রতিবেদক জানিয়েছেন। সচেতন মানুষ মাত্রই সমস্যাগুলো জানতে পেরে ক্ষুব্ধ হবেন। ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের একটা চিত্র এঁকে হয়তো মনের অজান্তে কেউ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলবেন। কেননা এসব সমস্যার জন্য যদি একটি শিল্পকারখানাকে গুটিয়ে নিতে হয়, তা হলে দেশ চলবে কীভাবে! সমস্যাগুলো তো সমাধানযোগ্য এবং ব্যয়বহুলও নয়। তবুও এসবের সমাধানে কর্তৃপক্ষের টনক নড়েনি। আর কতটি শিল্পকারখানা বন্ধ হলে তাদের টনক নড়বে সে হিসাবটা জানালে শিল্পমালিক তথা দেশবাসী উপকৃত হতেন। এমনিতেই দেশের ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের অনেকেই নানা দুর্ভোগ, চাঁদাবাজির কারণে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন। আবার কেউ কেউ দেশের প্রশাসনিক জটিলতা ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে তার স্বল্প পুঁজিটুকু হারিয়ে পথে বসতে চান না বলে বিনিয়োগ করছেন না। এ ধরনের পরিস্থিতিতে যদি দেখা যায়, সামান্য কতকগুলো সমস্যার কারণে বড় বড় শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, তা হলে সেই লজ্জাটা কার- সরকারের৯গ না শিল্পমালিকদের? এর উত্তর কে দেবে?

আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা দরকার। তা হলো, তেজগাঁও থেকে শিল্পকারখানা গুটিয়ে নেয়া বা স্থানান্তরিত হলেই কি সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? নিশ্চয়ই না। কেননা শিল্পকারখানা স্থানান্তর করলে শ্রমিকদের কী পরিণতি হবে? এই যে একটি কারখানায় বছরের পর বছর কাজ করে মাথার চুল পাকিয়ে ফেললেন যেসব শ্রমিক, তারা কি সহজেই পরিবার-সংসার নিয়ে স্থানান্তরিত হতে পারবেন, পারবেন অন্য কোনো পেশায় অভ্যস্ত হতে? এসব অনেক প্রশ্ন সামনে চলে আসে। এ ধরনের হাজারো প্রশ্ন করে পত্রিকার পাতা ভরে ফেলাও যাবে হয়তো। কিন্তু সেটা কোনো সমাধানের রাস্তা নয়। সমস্যার সমাধানই বড় কথা। আর এ দেশের সরকারগুলোকে বেশিরভাগ সময়ই সুদূরপ্রসারী কাজ বা চিন্তা বাদ দিয়ে খুচরা কাজে মগ্ন থাকতে দেখা যায়। কাজেই সরকারের কাছ থেকে ভবিষ্যতের জন্য ভালো কিছু আশা করাটা মনে হয় যেন বোকামি। তবু তাদের কাছেই সব কিছু আশা করতে হয়, আস্থা রাখতে হয়Ñ তাই হয়ে আসছে সবসময়।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, সমস্যাগুলো সাড়ে দশ বছর ধরেই বিদ্যমান। অর্থাৎ সাড়ে দশ বছর আগে থেকেই সৃষ্ট, যা মালিকরাই তাদের মন্তব্যে উল্লেখ করেছেন। ২০০০ সালের আগে ৪০ বছর ধরে তেজগাঁও এলাকায় শিল্পকারখানাগুলো সুষ্ঠুভাবে চলতে কোনো বিঘœ ঘটেনি। এখন ঘটছে, সাড়ে দশ বছর ধরেই ঘটে চলেছে। অথচ এই সময়ে তিনটি নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় ছিল। তেজগাঁও থেকে শিল্পকারখানা গুটিয়ে নেয়ার কারণ ব্যাখ্যা করেছেন মালিকরা। তবে একজন খুব বেশি অগ্রগামী ছিলেন তার মন্তব্যে। তিনি হলেন এফবিসিসিআই সভাপতি একে আজাদ। তিনি ব্যক্তিগতভাবে মনে করেন সেখানে (তেজগাঁওয়ে) কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান থাকা উচিত নয়। না থাকলে যানজট পরিস্থিতির উন্নতি হবে। ভালোই বলেছেন। তবে আরও ভালো বলতে পারতেন। যদি বলতেন, মহাখালী উড়াল সেতুর একটি সংযোগ তেজগাঁও সড়কে দিলে যানজট কিছুটা লাঘব হতো। একটি খাঁটি কথা অবশ্য বলেছেন এবং আমারও তাই মত। তা হলো, ঢাকার বাইরে অর্থনৈতিক এলাকা করা। শুধু বললেই তো হবে না, এর পক্ষে তাদের সংগঠন কী ভূমিকা নেবে তা ভবিষ্যৎই বলে দেবে। আমরা সে অপেক্ষায় থাকলাম। তবে একে আজাদ সাহেব যদি সমস্যাগুলো সমাধানে জোরালো পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলতেন তাহলে একটা আশার আলো তৈরি হতো।

সমস্যা থাকলে নিশ্চয়ই তার সমাধান আছে। কাজেই মনোযোগ দিতে হবে সমাধানের প্রতি। সরকার যদি চায় তেজগাঁও এলাকার শিল্পকারখানাগুলো অন্যত্র স্থানান্তরিত করতে, তারা তা করতে পারে। সেটা সরকারিভাবে করলেই ভালো। তবে না করলে সেখানকার বিদ্যমান সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধান করতে পদক্ষেপ নিতে হবে। তা না হলে আরও শিল্পকারখানা হয়তো বন্ধ হয়ে যেতে পারে। আবারও বেকার হয়ে পড়বে হাজার হাজার শ্রমিক। যাদের শ্রমে-ঘামে শিল্পকারখানাগুলো টিকে থাকে। ভবিষ্যতে ‘তেজগাঁও শিল্প এলাকা’ শুধু ঠিকানা হিসেবেই ব্যবহƒত হবে। মাঝখানের ‘শিল্প’ শব্দটি বিদ্রƒপ করবে সবাইকে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন