মঙ্গলবার, ১৩ জুলাই, ২০২১

পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ বিল : পারিবারিক-সামাজিক-রাষ্ট্রীয় অবসরের দায়


৮ নভেম্বর ২০১৩


‘ছেলে আমার মস্ত মানুষ মস্ত অফিসার/মস্ত ফ্ল্যাটে যায় না দেখা এপার ওপার/নানান রকম জিনিস আর আসবাব দামি দামি/সবচেয়ে কম দামি ছিলাম একমাত্র আমি/ছেলের আমার, আমার প্রতি অগাধ সম্ভ্রম/আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম।’…

উদ্ধৃত লাইন কয়টি পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় গায়ক নচিকেতার ‘বৃদ্ধাশ্রম’ গানের অংশবিশেষ। মা-বাবাকে নিয়ে গাওয়া হূদয়ছোঁয়া গান এটি এবং বেশ জনপ্রিয়ও। বিশেষত বৃদ্ধ মা-বাবার কাছে। জানি না

এ গান জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য মুজিবুল হক চুন্নুকে কতটা প্রভাবিত করেছিল! তবে ২০১১ সালে তারই উত্থাপিত ‘পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ বিল-২০১৩’ গত ২৪ অক্টোবর সংসদে কণ্ঠভোটে পাস হয়েছে। বিলটি পাসের জন্য মুজিবুল হক চুন্নু প্রত্যেক মা-বাবা, বিশেষত যারা নিদারুণ অসহায় জীবনযাপন করছেন, তাদের কাছ থেকে সাধুবাদ পেতেই পারেন। আর এ বিল পাসের পর সন্তানদের নাকে খত দেয়াই উচিত, যারা প্রতিষ্ঠিত হয়ে মা-বাবাকে দূরে ঠেলে দেয়।

বিলটি পাসের মধ্য দিয়ে আরেকটি করুণ চিত্র কিছুটা হলেও ফুটে ওঠে। তা হলো সমাজে নৈতিক, মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটেছে। তা না হলে এ ধরনের বিল পাসের প্রয়োজন ছিল বলে মনে হয় না। আমরা মানসিকভাবে কতটা নিচু পর্যায়ে গেলে সরকার এ রকম বিল পাসের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। যাহোক, এ আলোচনার আগে বিলের ওপর একটু নজর দেয়া যাক।

বিলে মা-বাবাকে ভরণ-পোষণ না দিলে সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে সর্বোচ্চ তিন মাসের জেলের বিধান রাখা হয়েছে। বিলের বিধান অনুযায়ী সন্তানের আয়ের যুক্তিসঙ্গত অংশ মা-বাবাকে দিতে হবে। একাধিক সন্তান থাকলে সেক্ষেত্রে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ভরণ-পোষণ নিশ্চিত করতে হবে। শুধু তাই নয়, মা-বাবার ভরণ-পোষণ না দিতে সন্তানের স্ত্রী বা স্বামী বা পুত্র-কন্যা বা নিকটাত্মীয় এ দায়িত্ব পালনে বাধা দিলে তারাও একই অপরাধে অভিযুক্ত হবেন। বিলে মা-বাবার অবর্তমানে নানা-নানি ও দাদা-দাদিরও ভরণ-পোষণ নিশ্চিত করার বাধ্যবাধকতার কথা বলা হয়েছে।

বিলে আরো বলা হয়েছে, প্রত্যেক সন্তানকে মা-বাবার একই জায়গায় একই স্থানে বসবাস নিশ্চিত করতে হবে। কোনো সন্তান তার মা-বাবাকে নিজ ইচ্ছার বিরুদ্ধে বৃদ্ধনিবাস বা অন্য কোথাও আলাদাভাবে বসবাসে বাধ্য করতে পারবে না। প্রত্যেক সন্তান নিজ নিজ মা-বাবার স্বাস্থ্য সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজখবর রাখবে এবং প্রয়োজনীয় চিকিত্সাসেবা ও পরিচর্যা করবে। মা-বাবা পৃথকভাবে বসবাস করলে সন্তানদের নিয়মিত সাক্ষাৎ করতে হবে। মোটা দাগে এ হলো বিলের বিবরণ। সর্বশেষ বিলটিতে রাষ্ট্রপতি সম্মতিও দিয়েছেন।

সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য কাজ করেছে সরকার বিলটি পাস করে। যেসব অসহায় বৃদ্ধ মা-বাবা সন্তানসেবা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত, যাদের বোঝা মনে করে দূরে ঠেলে দিয়েছে সন্তানরা, সেসব মা-বাবা তো সরকারকে অবশ্যই অভিনন্দন জানাবেন। এটাই স্বাভাবিক। বাঙালি মা-বাবার যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ শত প্রতিকূলতার মধ্যে সন্তানকে আগলে রাখা বা তার অন্যায়কে আড়াল করা; তারা এ আইনের আশ্রয় কতটুকু নেবেন, তা ভবিষ্যতে  দেখা যাবে। কিন্তু বিলটি পাসের মধ্য দিয়ে এ দেশের যে প্রকৃত বাস্তবতা এত দিন অপ্রকাশিত বা চাপা ছিল, সেটা বেরিয়ে এসেছে। সমাজের নৈতিক অবক্ষয় যে ঘটেছে, এ বিল পাসের মধ্য দিয়ে সে সত্যটা অস্বীকারইবা করি কী করে?

বাঙালি জাতির পারিবারিক যে ঐতিহ্য, মূল্যবোধ, পারস্পরিক শ্রদ্ধা-ভক্তি ও ভালোবাসা বোধ ছিল তা আজ হারাতে বসেছে। হারিয়ে গেছে বললেও হয়তো ভুল হবে না। যৌথ পরিবারগুলো ভেঙে টুকরো টুকরো হচ্ছে। পারিবারিক অনেক সম্পর্ক বিনষ্টের পথে। মানবিক মূল্যবোধ ধ্বংস হয়েছে। প্রভাব-প্রতিপত্তির নিচে এখন এসব চাপা পড়ে গেছে। বদলে পেশিশক্তি জায়গা করে নিয়েছে। আদর্শ, নীতি-নৈতিকতা, সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগ ধীরে ধীরে বিসর্জিত হচ্ছে সমাজ থেকে। যার ফলই হচ্ছে মা-বাবাকে ছুড়ে ফেলা, ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদের বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দেয়া। সব সন্তানই এ মানসিকতার তা বলছি না। ব্যতিক্রম তো আছেই। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, সেজন্য শুধুই কী সন্তানরা দায়ী? মা-বাবা, পরিবার, সমাজের কী কোনো দায়বদ্ধতা নেই? অবশ্যই আছে। পাশাপাশি দায় মিডিয়ারও আছে। বিশেষত স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর। নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে ভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর ফ্যামিলি মেগাসিরিয়ালগুলো এক্ষেত্রে যথেষ্ট ভূমিকা রাখছে। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত এ-বিষয়ক অনেকের লেখাতেও এ কথাই উঠে এসেছে বারবার। ২৫ সেপ্টেম্বর সামাজিক যোগাযোগের সাইট ফেসবুকে এক  ব্যবহারকারী স্ট্যাটাসে বলা হয়, ‘দেশের সংস্কৃতি এবং পারিবারিক বন্ধন অক্ষুণ্ন রাখতে ভারতীয় চ্যানেলগুলো বন্ধ রাখুন। অবাধ যৌনতা, পরকীয়া আর বউ-শাশুড়ির কূটনামি এসব প্যাচাল নিয়েই ভারতীয় সিরিয়ালগুলো ধ্বংস করছে এ দেশের মানুষের মূল্যবোধ। খেলা এবং ডকুমেন্টারি চ্যানেল বাদে অন্যান্য ভারতীয় হিন্দি ও বাংলা চ্যানেলগুলো লক করে দিন। ক্যাবল অপারেটরও বলতে পারেন এগুলোর প্রচার বন্ধ করতে। আমাদের স্বার্থে আমাদেরই সচেতন হতে হবে।’

এককভাবে শুধু মিডিয়া বা টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর ওপর দায় চাপিয়ে লাভ নেই। নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের পেছনে রাষ্ট্রের ভূমিকা আছে, ভূমিকা আছে পরিবার ও সমাজেরও। সর্বোপরি মা-বাবারও ভূমিকা থাকে সন্তানের নৈতিক অবক্ষয়ের পেছনে। প্রত্যেক মা-বাবাকে নিয়ে এ অভিযোগ করছি না। সন্তানের বেড়ে ওঠাটা কীভাবে হবে, তা মা-বাবা থেকেই নির্ধারিত হয়। এটাও বাস্তব সত্য যে, অনেক মা-বাবা অত্যন্ত কষ্টে সন্তানদের প্রতিষ্ঠিত করে থাকেন। কিন্তু একসময় সেসব সন্তানরা মা-বাবাকে ভুলে যায়, দূরে সরিয়ে দেয়। এমন ঘটনা হরহামেশাই দেখা যাচ্ছে সমাজে। তার প্রমাণ দেশের বৃদ্ধাশ্রমগুলো। পেশাগত দায়িত্ব পালনে একবার গাজীপুরে গিভেন্সি গ্রুপ পরিচালনাধীন বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে যেতে হয়েছিল। সেখানে থাকা অসহায় মা-বাবার করুণ কাহিনীগুলো শোনার পর নিজেকে ধরে রাখাটা কঠিন হয়ে পড়েছিল। হয়তোবা নিজের ভবিষ্যৎ চিন্তায়! তবে এ লেখাটির সময় সবচেয়ে বেশি মনে পড়ছিল প্রয়াত সাংবাদিক আতাউস সামাদের কথা। তিনি প্রায়ই সমাজের, পরিবারের অবক্ষয়ের কথা বলতেন। পারিবারিক সম্পর্কের টানাপড়েনের কথা বলতেন। কী জন্য এসব ঘটছে আর এসবের জন্যই বা দায়ী কে— বিষয়গুলো বোঝাতেন।

পরিশেষে যে বিষয়টি না বললেই নয়, মানবিক মূল্যবোধ ও সামাজিক আচার-রীতি ভুলে যাওয়া, যৌথ পরিবার ভেঙে যাওয়া, পারিবারিক সম্পর্কের টানাপড়েন, নৈতিক অবক্ষয়— এসবের জন্য আর্থিক অসচ্ছলতা অন্যতম কারণ। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যতই প্রচার করা হোক না কেন, দেশে মাথাপিছু আয় বেড়েছে, প্রত্যেক নাগরিক খেয়ে-পরে বেঁচে থাকতে পারছে, তারপরও আর্থিক অসঙ্গতি প্রকট আকার ধারণ করছে দিনকে দিন। আর অধিকাংশ মানুষ যখন সস্তা বিনোদনের ঝুঁকে পড়ে, তখন দেশের অর্থনৈতিক সংকটের চিত্রটাই বেরিয়ে আসে। এছাড়া নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের আকাশছোঁয়া দামের সঙ্গে তাল মেলাতে নাভিশ্বাস উঠছে এ দেশের সাধারণ মানুষের। মজুরি বোর্ড নির্ধারিত পোশাক শ্রমিকের সর্বনিম্ন বেতন ৫ হাজার ৩০০ টাকা দিতেও অপারগ মালিকপক্ষ। প্রশ্ন— সর্বনিম্ন এ বেতন দিয়ে একজন শ্রমিক ঢাকা শহরের কতটুকু সচ্ছলভাবে জীবনযাপন করতে পারবেন? কিংবা এ বেতন নিয়ে শ্রমিক তার সন্তানের লেখাপড়া কতদূরইবা এগিয়ে নিতে পারবে। এ বাস্তবতা আমাদের উপলব্ধি করতে হবে। একসময় এ রাজধানী ঢাকাতেই এক মাসের বেতন দিয়ে এক কাঠা জায়গা পাওয়া গেছে। আর এখন! আধা হাতের স্বপ্ন দেখাও কঠিন। পরিবার ভেঙে যাওয়ার পেছনে এ কারণগুলোও বিদ্যমান। তাই সমাজকে বাঁচাতে হলে এ কারণগুলোর সমাধান জরুরি।

কাজেই অবক্ষয় দূর করতে হলে মা-বাবার পাশাপাশি পরিবার ও সমাজকেও দায়িত্ব নিতে হবে। আর রাষ্ট্রকে তো বড় ভূমিকাটাই নিতে হবে— এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। প্রত্যেক নাগরিক যখন তার প্রাপ্য যথাযথভাবে পেতে থাকবেন, তখন অবক্ষয় নামক শব্দটি পালাতে বাধ্য। আর সেটি জোগান দেয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রের ঘাড়েই বর্তায়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন