বৃহস্পতিবার, ২৯ জুলাই, ২০২১

এগোচ্ছি, না পেছাচ্ছি?

চাঁপাইনবাবগঞ্জ
১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪


স্বাধীনতার পাঁচ বছর পর জন্ম। সে সময়টা চোখে দেখা না হলেও তখনকার কথা বা গল্প শোনা হয়েছে বিস্তর। বেড়ে ওঠাটাও সেভাবে। শুনেছি একাত্তর-পরবর্তী সময়ে দেশে একজন চাকরিজীবী এক মাসের মাইনে দিয়ে অনেক কিছুই করতে পেরেছিলেন। খাদ্য, চিকিৎসা, বাসস্থান সর্বোপরি সন্তানদের লেখাপড়া সবই হয়েছে। এমনই শোনা গেছে যে, এক মাসের মাইনে দিয়ে স্থানভেদে এক বিঘা জমিও পাওয়া গেছে। এসব শুনে বড় হলেও এখন বাস্তবে তার উল্টো চিত্র। নিম্নমধ্যবিত্তঘরানার মানুষদের এক

মাসের মাইনে দিয়ে ৩০ দিন পার হওয়া তো দূরে থাক, ১৫ দিন পর সিঁকি পয়সাও খুঁজে পাওয়া দুষ্কর পকেটের মধ্যে। প্রশ্ন জাগে, সে সময়কার গল্প শুধুই কী গল্প, নাকি বাস্তব ভিত্তি ছিল। যদি থেকেই থাকে তবে বর্তমানে সাধারণ মানুষের জীবনযাপন দিন দিন জটিল হচ্ছে কেন? সে সময়কে তুলনায় নিলে এখন তো জীবনযাপন আরও সহজ হওয়ার কথা। তা না হয়ে কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে। আমরা কি এগিয়েছি, দেশ কি সত্যিকার অর্থেই এগিয়েছে? এর যথার্থ উত্তর অর্থনীতিবিদরাই হিসাব কষে দিতে পারেন। 

আমাদের মতো সাধারণ মানুষের পক্ষে তা হিসাব কষে বের করা সম্ভব নয়। আমাদের ভেতর প্রশ্ন আছে, উত্তর নেই। আমরা ভোট দিতে জানি, রাজনীতির বলি হতে জানি। জানি আলোচনার টেবিলে শ্রোতা হয়ে বসে থাকতে। আমাদের হাত-পা বাঁধা নেই। মুখেও টেপ পরা নেই। তবু অদৃশ্য শক্তির কারণে বলতে বাধা আছে। হাত খুলে লিখতেও ভয় আছে। লেখা ছাপতেও ভয় আছে, ছাপাতেও ভয় আছে। এখন পত্রিকাগুলোকে একটা লেখা নিয়ে হাজারবার ভাবতে হয়Ñ লেখা ছাপা যায় কিনা, কারো বিপক্ষে যায় কিনা প্রভৃতি বিষয়।

প্রকাশ্যে সাহস দেখাবার জো-ও নেই আর্থিক সচ্ছলতার অভাবে। অকারণে প্রাণহানি ঘটলে পথে বসতে হতে পারে কয়েকজন মানুষকে। সে ভয় প্রতিনিয়ত সাধারণ মানুষকে বিরত রাখে প্রতিবাদের জায়গা থেকে। এ ধ্রুব সত্য অনেক সময় উপাধি পায় ‘কাপুরুষোচিত’ মনোভাবের। ভেতরের সত্যটা চাপাই থেকে যায়। এই মানসিক পীড়ন নিয়ে অনেককেই সামনে এগোতে হয়। 

দেশের কোন খাতটাইবা আজ দুর্নীতিমুক্ত আছে, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কি তা বলতে পারবে? খোঁজ নিলে দেখা যাবে, দুদকই হয়তো দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে বা পড়ছে। কিন্তু মানুষ কেন প্রতিনিয়ত দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছেÑ এর উত্তর কি কখনো খোঁজার চেষ্টা করেছে রাষ্ট্র বা সরকার। করলে দেশ উপকৃত হতো, তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। শুধু দুর্নীতির বিচার করলে হবে না, কেন দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছে তার উত্তর আগে খুঁজে বের করতে হবে। যোগ্যতা থাকার পরও কেন লাখ লাখ টাকা ‘উৎকোচ’ দিয়ে চাকরি নিতে হচ্ছে একজন মেধাবীকে? এ প্রশ্নও আজ উঠতে বাধ্য। 

আমরা এগিয়েছি, অনেকটাই এগিয়েছি। ইতিবাচক না নেতিবাচকভাবেÑ সে বিতর্ক পরে। তবে বলতে পারি, এখন লুঙ্গি পরে বাজারে যেতেও লজ্জা লাগে, তাই প্যান্ট পরতে শিখেছি। সেলফোন ব্যবহার করতে শিখেছি। বাসায় ডিস সংযোগসহ টেলিভিশন দেখতে শিখেছি। এতেও না হলে ডিভিডি প্লেয়ার কিনতে শিখেছি। এসব ব্যবহারে মাসের মাইনে দিয়ে কুলাতে না পারলে ধার করতে শিখেছি ‘আধুনিক মহাজনী’ প্রতিষ্ঠান থেকে। এক প্রতিষ্ঠান থেকে ধার নিয়ে আরেক প্রতিষ্ঠানকে শোধ দেই। এভাবেই এগিয়ে যাচ্ছি ‘ডিজিটালাইজড’ হয়ে।

এগিয়ে গেছি অনেকটাই। তাই তো এখন রংপুর কারমাইকেল কলেজ, পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ, রাজশাহী কলেজের মতো প্রভৃতি নামকরা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভুলে যেতে বসেছি। এখন এসব প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করার স্বপ্নও আর কেউ দেখেন না। একসময় হয়তো স্মৃতি হাতড়ে দেখতে হবে এসব প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মানও আজ এশিয়াতে ৩ হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের নিচে। তারপরও দেশ এগিয়েছে। আর এগিয়েছে বলেই রাজনৈতিক বিভাজনের ভয়ে শিক্ষকরাও এখন ক্লাসে ক্ষুদিরাম বসু, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, মওলানা ভাসানী প্রমুখ মনীষীদের গল্প বলতে ভুলে গেছেন। শিক্ষার্থীরাও ভুলে গেছেন সৈয়দ মজতুবা আলীর ‘পণ্ডিতমশাই’ গল্পের লাটসাহেবের তিন ঠ্যাংওয়ালা কুকুরের কথা। ভুলে গেছেন ‘পথ জানা নেই’ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র গওহরের কথা। গ্রামের সাধারণ মানুষ গওহর উন্নয়নের জন্য নিজের জমি সড়ক নির্মাণে দান করে কীভাবে নিঃস্ব হলেন, সেই গল্পও। পরিবর্তন হয়েছে অনেক। শিক্ষা এখন পণ্য হয়েছে, তার বাণিজ্যিকীকরণ ঘটেছে। আর এর দাপটে অপেক্ষাকৃত দরিদ্র মেধাবীরা ছিটকে পড়ছে উচ্চশিক্ষা থেকে।

দেশ এগিয়েছে, ভালোভাবেই এগিয়েছে। কাঁচা রাস্তা বদলে পাকা হয়েছে। নদীতে পানিপ্রবাহের ব্যবস্থা না থাকলেও পারাপারে সেতু হয়েছে। যমুনা সেতু হয়েছে। তার বদৌলতে উত্তরবঙ্গে দু’চারটে কোল্ডস্টোরেজ হয়ে কর্মসংস্থান ঘটিয়েছে। নদীমাতৃক দেশে ফিল্টার বা মিনারেল ওয়াটারের বোতলে বাজার ছেয়ে গেছে। সাবান এখন হালাল হয়েছে। এলপি গ্যাসের দাম প্রতি মাসে বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে। ওষুধের দাম বড়তেই আছে। লোকাল গাড়ি সিটিং হয়েছে। আমদানি আট আনা হলেও খরচ বারো আনায় হচ্ছে। 

বিপদে পড়লে পুলিশের কাছে যেতে ভুলে গেছি। পুলিশ দেখলে এক শ হাত দূর দিয়ে চলি। বদলেছে, অনেক কিছুই বদলেছে, অনেকেই বদলে গেছে। বিডিআর তার ঐতিহ্যবাহী নাম বদলেছে। মানুষ তার মানবিক গুণ হারাতে বসেছে। পারিবারিক মূল্যবোধ ভেঙে যেতে বসেছে। তবে বদলে গেলেও সাধারণ মানুষের জীবন থেকে একটি গল্প এখনো হারিয়ে যায়নি। তাহলো, তৈলাক্ত বাঁশে বানরের ওঠার গল্প।

বদলে বা এগিয়ে যাওয়ার গল্প লিখে শেষ করা যাবে না। তবে স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পেরিয়ে দেশের নাগরিকদের প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির মাঝে রয়ে গেছে বিস্তর ফারাক। প্রত্যাশা সব সময়ই পূরণ হওয়ার নয়। তার মানে এই নয় যে, নাগরিক তার রাষ্ট্রের প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন। দেশ একেবারে যে এগোয়নি, তা বলা ভুল হবে। এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ইতিবাচক কাজও হয়েছে। তবে স্বাধীনতার চার দশক পর এখন হিসাব মেলানোর সময় এসেছে, কতটা এগিয়েছি? একটি রাষ্ট্রে নাগরিকদের ন্যূনতম যে চাহিদা, তার কতটুকুইবা পূরণ হয়েছে? ব্যক্তিগত সাফল্যের চেয়ে সমষ্টিগত সাফল্যই এগিয়ে যাওয়ার প্রতীক। সে অর্থে আমরা কতটুকু এগিয়েছি, তার উত্তর দেশের বোদ্ধা, বুদ্ধিজীবী সমাজ আর অর্থনীতিবিদরাই ভালো দিতে পারবেন। আর আমরা জানি শুধু অপেক্ষা করতে!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন