মঙ্গলবার, ১৩ জুলাই, ২০২১

স্মরণ : রানীমা ইলা মিত্র


১৩ অক্টোবর, ২০১১


‘আপনি তো ভাই বিখ্যাত এলাকার মানুষ।’ ‘গ্রামের বাড়ি কোথায়?’- এ প্রশ্নের উত্তরে এলাকার নাম বললেই বেশির ভাগ মানুষ এমন কথাই বলেন। যে মানুষকে কেন্দ্র করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নাচোল উপজেলা বিখ্যাত, সেই মানুষটি আর কেউ নন, তিনি একজন সংগ্রামী কৃষক নেতা, একজন বাঙালি মহীয়সী নারী, তেভাগা আন্দোলনের অন্যতম নেতা ইলা মিত্র। সাঁওতাল কৃষকরা যাকে ভালোবেসে ‘রানীমা’ উপাধি দিয়েছিল। মহীয়সী এই নারী শোষিত, বঞ্চিত কৃষকদের অধিকার আদায় প্রতিষ্ঠায়

সংগ্রাম করেছেন। এ জন্য সয়েছেন অমানুষিক নির্যাতন।

আজ ১৩ অক্টোবর। রানীমা ইলা মিত্রের নবম মৃত্যুবার্ষিকী। রানীমার মৃত্যুর ৯ বছর পার হতে চললেও একটা চাপা কষ্ট বুকের ভেতর বিদ্যমান। তবে সান্ত্বনা পাই এ ভেবে যে, রানীমা নাচোল আসার পেছনে আমাদের গুটিকয় তরুণেরও ভূমিকা ছিল; যা গর্ব করে বলতে পারি।

মৃত্যুর ছয় বছর আগে নাচোল এসেছিলেন ইলা মিত্র। তার আগে বেশ কয়েকবার এ দেশে এলেও কখনো নাচোল যাননি। না যাওয়ার কারণ মৃগাঙ্ক সিং (তার একটি বইয়ের নাম সম্ভবত ‘বনমোরগের ডাক’) নামে এক লেখকের কাছ থেকে জানতে পেরেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, নাচোলবাসী স্মরণ করলে নাকি রানীমা নাচোল আসবেন। যত দূর মনে পড়ে, সময়টা ১৯৯৩ সাল। এর পর অনেক চেষ্টা চালিয়ে ১৯৯৫ সালের শেষ দিকে কয়েকজন মিলে রানীমা ইলা মিত্রের নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলাম। পরের বছর অর্থাৎ ১৯৯৬ সালের জুনে তেভাগা আন্দোলন ও ইলা মিত্রের ওপর আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। আলোচনা সভায় অতিথি ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষক- প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক, প্রাবন্ধিক শহিদুল ইসলাম ও কবি-সাহিত্যিক জুলফিকার মতিন। এ কথা ঠিক যে, সে আলোচনা সভা ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল নাচোলের বাইরেও।

এর দুই-তিন মাস পর রাজশাহীর বাম নেতা ফজলে হোসেন বাদশা আমাকে ডেকে পাঠান। যথারীতি তার সঙ্গে দেখা করি। এই আলোচনা সভা করার জন্য তিনি ধন্যবাদ জানান। কথা প্রসঙ্গে বলেন, আলোচনা সভার খবর ইলা দিকে ফোনে জানানো হয়েছে। তিনি খুবই খুশি হয়েছেন এবং নাচোল আসতে চাচ্ছেন। রানীমা আসতে চাচ্ছেন শুনে খুব গর্ব অনুভব করছিলাম। যাক, কিছুটা হলেও আমরা সাড়া ফেলতে পেরেছি।

এর পর সত্যিই রানীমার নাচোল আসার দিনক্ষণ ঠিক করে অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে ফজলে হোসেন বাদশা আবারও ডেকে পাঠালেন। খবরটা শুনে সে দিন আনন্দে চোখে জল গড়িয়ে পড়ার উপক্রম হয়েছিল। রানীমার নাচোল আগমন উপলক্ষে কমিটি গঠন করা হলো। কমিটির নাম দেয়া হলো- ‘তেভাগা কৃষক আন্দোলনের ৫০ বছর পূর্তি উদযাপন কমিটি’। আমার দায়িত্ব পড়ল পত্রিকা বের করার। অথচ সময় মাত্র ১৫ দিন। এই ১৫ দিনের মধ্যেই লেখা সংগ্রহসহ পত্রিকা বের করতে হবে। দুরূহ একটা ব্যাপার ছিল তখনকার জন্য। কারণ সে সময় শুধু খবর লিখে পত্রিকা অফিসে পাঠিয়ে খালাস। বাকি কাজটা কীভাবে হতো, তা জানা ছিল না। পত্রিকার নাম ঠিক হয় ‘নাচোলে ইলা মিত্র’। ভুল-ত্র“টি যা-ই হোক না কেন, পত্রিকাটি শেষ পর্যন্ত বের করতে পেরেছি- এই ছিল সান্ত্বনা। অবশ্য এর আগে ফজলে হোসেন বাদশাকে বলে রানীমার সাক্ষাৎকার নেয়ার ব্যবস্থা করি। ঠিক হয় নাচোলের জনসভার পরদিন চাঁপাইনবাবগঞ্জ সার্কিট হাউসে বসে সে সাক্ষাৎকার নেয়া হবে।

এল সে মাহেন্দ্রক্ষণ, ৬ নভেম্বর ১৯৯৬। সে দিন নাচোল কলেজ মাঠে সাঁওতাল ছাড়াও নানা বর্ণের মানুষের ঢল নেমেছিল। যেদিকে তাকাই, শুধু মানুষ আর মানুষ। তিল ধারণের জায়গাটুকুও যেন ছিল না। এর পর মঞ্চে উঠলেন তেভাগা আন্দোলনের বিপ্লবী নেতা ইলা মিত্র। রোগাক্রান্ত দেহ, সোজা হয়ে হাঁটতেও পারছিলেন না। অথচ এ মানুষটিই তৎকালীন সরকারের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন, ভাবাই যায় না। যাকে কখনো দেখতে পাব বলে ভাবিনি, সেই রানীমাকে এত কাছ থেকে দেখছি। আশার বাস্তবায়ন ঘটলে ভেতরে কী অনুভূতি হয়, তা হয়তো লিখে বোঝানো কঠিন।

এর পর রানীমাকে নিজ হাতে পত্রিকা দিলাম। দিলাম একটি উপহারও, ওয়ালম্যাট।

পর দিন ৭ নভেম্বর নির্ধারিত ছিল তার সাক্ষাৎকার নেব। কিন্তু কষ্টের বিষয় এই, আমার যাওয়া হয়নি তার কাছে। কয়জন শুভাকাক্সক্ষী রানীমার সঙ্গে সময় কাটিয়ে এলেও দুর্ভাগ্য আমারই। সুযোগ পেয়েও তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করা হলো না। আজও সেই কষ্ট ভুলতে পারি না।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন