মঙ্গলবার, ১৩ জুলাই, ২০২১

মেঘের চোখের জল যেন বৃথা না যায়


ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০১২


ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। বলার ভাষা নেই, সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা নেই, নেই প্রতিবাদের ভাষা। বুকের ভেতর জমাট বেঁধে থাকা ক্ষোভ-ব্যথা প্রকাশেরও ভাষা নেই। ভাষা হারিয়ে গেছে নির্বাক ‘মেঘে’র আড়ালে। ভাষা চাপা পড়ে গেছে মেহেরুন-সাগরের রক্তের নিচে। গুমরে গুমরে কেঁদে মরি, চোখের জলে আকুলতা প্রকাশ করি রাষ্ট্রের কাছে- স্বাভাবিক মৃত্যুর দাবিতে। সবই অরণ্যে রোদন। তাই তো রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের ৫৮/১/২ নম্বর বাড়ির পঞ্চম তলার ফ্ল্যাটটির রক্ত ধুয়ে-মুছে রাষ্ট্রের দায় শেষ!

রাষ্ট্রের হাঁকডাক শুনতে শুনতে আর হম্বিতম্বি দেখতে দেখতে বড্ড বেশি বিরক্ত আমরা।

কথা নয়, এখন কর্মে প্রমাণ দেয়ার সময়। মুখের কথায় চিঁড়া ভাজার দিন শেষ।সাংবাদিক দম্পতি মেহেরুন-সাগরের মৃত্যুর ঘটনায়ও আমরা রাষ্ট্রের হাঁকডাক শুনতে পেলাম। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশও পেলাম- ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের ধরা হবে। সে সময়সীমা পার হয়েছে। খুনি বা খুনিরা এখনো ধরা পড়েনি (সোমবার রাত ১২টা পর্যন্ত)। বরং পুলিশের আইজি ১৩ ফেব্র“য়ারি সংবাদ সম্মেলন করে আরও সময় চাইলেন। জানি না তিনি এ জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের কাছে জবাবদিহি করবেন কি না? তা না করুন; অন্তত এটুকু স্বীকার করুন যে, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। আর দেশে যখন এমন পরিস্থিতি বিরাজ করে, তখন অর্থনৈতিক মন্দাকেও কারণ হিসেবে ধরা হয়। সাধারণ মানুষের মধ্যে সচ্ছলতা না থাকলে সামান্য কারণেই মানুষ ভযাবহ ঘটনার মধ্যে জড়িয়ে পড়ে। সে আলোচনায় যাচ্ছি না। তবে ১১ ফেব্র“য়ারি মেহেরুন-সাগর হত্যাকাণ্ডের খবর শোনার আগে সকালে সংবাদপত্রে গোটা দশেক খবর ছাপা হয়েছে, যেগুলো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির চিত্র তুলে ধরে। এ কথাও সত্য যে, প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো হত্যাকাণ্ডের খবর শুনে বা পড়ে প্রত্যেক নাগরিকের দিনটা শুরু হয়।স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্বীকার করবেন কী- দেশের মানুষ এখন তার বাসার দরজা খুলতে ভয় পায়, বাসে-ট্রেনে উঠতে ভয় পায়, ভয় পায় রাতে পথ চলতে? কেন? সেটা তো নিশ্চয়ই জানেন- মানুষ স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা চায়। কিন্তু সে নিশ্চয়তাটুকু পাওয়া তো দূরে থাক, মানুষ ন্যায়বিচারের আশায় এখন পুলিশের কাছে ঘেঁষতেই ভয় পায়। এই হচ্ছে দেশের অবস্থা।

ছোট্ট মেঘের নিষ্পাপ আর্তি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর চোখে পড়েছে কি না জানি না। পড়ে থাকলে কী সান্ত্বনাই বা তাকে তিনি দিয়ে এসেছেন। তবে এ প্রশ্ন করাই যায়, তাহলো শিশু মেঘের অপরাধ কী ছিল এবং কেনই বা তার সামনে মা-বাবাকে খুন করা হলো? মেঘ যদি এ ঘটনায় কোনো ফিল্মি নায়কে রূপান্তর হয়, তার দায় কে নেবে- রাষ্ট্র না মেঘ নিজেই? আমরা চাই না মেঘের জীবনে এরকম কোনো ঘটনা ঘটুক। চাই ছোট্ট মেঘ তার অপরিণত বয়সের শোককে কাটিয়ে উঠুক এবং দূর করুক সমাজের অন্ধকারগুলো। আলো ফোটাক মেধা দিয়ে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথা প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন, ছোট্ট মেঘের চোখের জল যেন বৃথা না যায়। মেঘের জল শুকিয়ে যাওয়ার আগেই খুনিদের সাজা হোক। যে সাজা মেঘকে স্বাভাবিক পরিবেশে বেড়ে উঠতে সহায়তা করবে।

অতীতে অনেক সাংবাদিকই নির্মম হত্যাকাণ্ডের স্বীকার হয়েছেন। কোনোটির সুষ্ঠু বিচার হয়েছে বলে জানা নেই। বিচারপ্রক্রিয়া চলতেই আছে। কবে শেষ হবে, তারও নেই কোনো ধারণা। বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতাও কম দায়ী নয় এ ক্ষেত্রে। তারপর আছে রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি। অপরাধী কি না, তা শনাক্ত না করেই শুধু দলীয় বিবেচনায় অনেকেই পার পেয়ে যাচ্ছেন প্রকাশ্যে অপরাধ করেও। কাজেই শুধু অপরাধীকে ধরলেই হবে না, অপরাধের শেকড় ছেঁটে ফেলতে হবে।

আশাহত হই তবু আস্থা রাখতে হয়। তাই আবারও আস্থা রাখছি এই রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে। সাংবাদিক দম্পতি মেহেরুন-সাগর হত্যাকাণ্ডের বিচারের দ্রুত নিষ্পত্তি হোক, খুনিরা সাজা পাক- এটাই আমাদের চাওয়া। প্রকৃত এবং যথাসময়ে বিচার হলে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। সমাজ থেকে অপরাধ দূর করতে হলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা জরুরি। আর আইনটি অবশ্যই হতে হবে কাক্সিক্ষত মানের। আশা করি, বর্তমান সরকার সে পথেই এগোনোর চেষ্টা করবে।

এ তো গেল রাষ্ট্রযন্ত্রের কথা। মেহেরুন-সাগরের মৃত্যুর ঘটনাকে ঘিরে সাংবাদিকদের মধ্যে ঐকমত্য দেখা গেল কম। রাজনৈতিক পরিচয়ই এখন বড় হয়ে উঠছে তাদের কাছে। এ কারণে একতার জায়গাটাও নড়বড়ে হয়ে গেছে, যার ফায়দা লুটছে দুষ্কৃতকারীরা। সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের ওপর নেমে আসছে একের পর এক খক্ষ। দেশের সাধারণ মানুষ সাংবাদিকদের যে শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছিল, তাও হারাতে বসেছে। ক্ষেত্রবিশেষে সাংবাদিকরাও ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন। সময় এসছে সব সংবাদপত্র ও সাংবাদিককের এক হওয়ার। নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই এক হতে হবে। গড়ে তুলতে হবে সুন্দর সমাজব্যবস্থা, যেখানে স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা থাকবে। আর তা করতে সর্বাগ্রে সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকদেরই রাখতে হবে বলিষ্ঠ ভূমিকা। প্রয়োজনে সহযোগিতা মিলবে সাধারণ মানুষের। দরকার শুধু সদিচ্ছার।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন