মঙ্গলবার, ১৩ জুলাই, ২০২১

রাজনীতির আকাশে দুর্যোগের ঘনঘটা


৭ জুলাই, ২০১১


শুক্রবার, ১ জুলাই দৈনিক বণিক বার্তায় প্রকাশিত সাংবাদিক এমএম মুসার ‘রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনীতি’ লেখাটি পড়ে সে বিষয়ে লেখার মনোবাসনা জাগে। কেননা বণিক বার্তাকে যে ঘরানার সংবাদপত্র মনে হয়েছে, তাতে এ রকম লেখা প্রকাশিত হবে তা আশা করিনি। এমএম মুসা তার ছোট্ট লেখাটিতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটের সব চিত্রই তুলে ধরেছেন। পরিশেষে তিনি দেশ ও জনগণের দিকে তাকিয়ে হলেও যত দ্রুত সম্ভব দীর্ঘদিন ধরে জিইয়ে রাখা এসব সমস্যার সমাধান

করার জন্য দেশের সরকারি-বিরোধী উভয় দলের প্রতি অনুরোধ রেখেছেন। তার এ অনুরোধের সঙ্গে একমত পোষণ করে কিছু বলতে চাই। 

দুঃখজনক হলেও সত্য, এ দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি কখনো ভালো পরামর্শ গ্রহণ করতে চায় না। ক্ষমতায় গেলে তাদের ভাবটা সব সময় এমনই থাকে- আমরা আর সবার চেয়ে ভালো বুঝি, যা করি দেশের স্বার্থেই করি। স্বার্থ যে কার উদ্ধার হয়, সেটা তো দেশবাসী ভালোভাবেই দেখতে পায়। ছোট্ট একটা উদাহরণ- ১৯৯৬ সালে বিএনপি সরকার যদি তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা মেনে নিত, তা হলে দেশের পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতো না। মেনেছে, তবে জল ঘোলা করে।এ দেশের জনগণ সুদিনের জন্য বারবার এ দুটি রাজনৈতিক দলের ওপর ভরসা করলেও ১৯৯১ সালের পর এ পর্যন্ত দুই দলই দু’বার ক্ষমতার স্বাদ পেলেও জনগণের ভাগ্যের খুব একটা হেরফের হয়নি। হলেও তা একটি শ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকেছে। মাঝখান থেকে দুই দলের নেতাকর্মীরা ফুলেফেঁপে উঠেছে, নিজেদের আখের গুছিয়েছে বেশ ভালোভাবেই; যাতে ভবিষ্যতে ওই আয় দিয়েই বাকিটা সময় চলতে পারে।

একটা প্রবাদ চালু আছে। যে যায় লংকায়, সে-ই হয় রাবণ। বাংলাদেশের রাজনীতির অবস্থা সে রকমই। ক্ষমতার মসনদে বসলে সব কিছু ভুলে যায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। নিজেদের ভালো-মন্দের বাইরে অন্য কিছু ভাবতে পারে না তারা। দেশের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়লেও কোনো দুশ্চিন্তা নেই। দেশের মানুষ সব সময়ই অর্থনৈতিক মুক্তি কামনা করে। অর্থনৈতিক মুক্তি পেলে দেশের মানুষ হয়তো তাদের (দুই দলের) অন্য সব কিছু গায়ে মাখত না। কিন্তু তা ঘটছে না। বরং অর্থনৈতিক সংকট, নিরাপত্তাহীনতা, জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি- এসব মোকাবেলা করেই চলতে হচ্ছে দেশের মানুষকে। তবে সেটা কত দিন? দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে সামনে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া যখন আর কোনো পথ খোলা থাকবে না তখন কী হবে? এই চিন্তাটা কি এ দেশের শাসকশ্রেণী তথা রাজনৈতিক দলগুলো কখনো করে?

চারদলীয় জোট সরকারের অনিয়ম-দুর্নীতিতে অতিষ্ঠ সাধারণ মানুষ সুদিনের আশায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় মহাজোটকে নির্বাচিত করে। মাঝখানে দুই বছর অনির্বাচিত সরকারের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়েছিল মানুষ। আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করে। কিন্তু চারদলীয় জোট সরকারের মতো এ সরকারও একই পথ ধরেছে। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই দলের নেতাকর্মীরা সারাদেশে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি ও দখলে ব্যস্ত হয়ে পড়ে; যার খবর প্রতিদিনই দেশের জাতীয় সংবাদপত্রগুলোয় প্রকাশিত হয়েছে। এ নিয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারাও পর্যন্ত বিব্রত বোধ করেছিলেন এবং কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলীর বৈঠকে এ বিষয়ে সাবধান বাণী উচ্চারণ করা হয়েছিল।

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের বয়স আড়াই বছর পার হতে চললেও দেশের মানুষ এখনো স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারেনি। আগামীতেও পারবে কি না সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। বাংলার আকাশে আবারও কালো মেঘের ঘনঘটা। রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত হয়ে উঠছে, অর্থাৎ আবারও ২০০৬ সালের পুনরাবৃত্তি ঘটার আশঙ্কায় শঙ্কিত সাধারণ মানুষ। যে ঘটনার শিকার হয়ে এ দেশের মানুষকে দুই বছর জিম্মি হয়ে থাকতে হয়েছিল, নিজ দেশে পরবাসের মতো। সাধারণ মানুষ এ সংকট থেকে উত্তরণ চান, দুই বেলা পেট পুরে খেতে চান। বসবাসের জন্য নিরাপত্তা চান। এ দেশের মানুষের চাওয়া-পাওয়া খুবই সীমিত। তবুও বারবার ভাগ্যবিড়ম্বিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। যাদের টাকায় সরকার চলে, তারাই নির্যাতিত হচ্ছে বারবার। দাবি আদায়ের যেকোনো আন্দোলনকে তারা টুঁটি চেপে ধরছে। তার প্রমাণ আবারও দেখা গেল ৩ জুলাই, তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি আহূত হরতালের দিন। তেল-গ্যাস রক্ষা জাতীয় কমিটি মার্কিন কোম্পানি কনোকো-ফিলিপসের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি বাতিলের দাবিতে অর্ধদিবস হরতাল আহ্বান করে। এই কমিটি শাসকশ্রেণীর দুই দল আওয়ামী লীগ বা বিএনপির চেয়ে বড় কোনো সংগঠন নয়। তবুও আওয়ামী লীগ সরকার যে অর্ধদিবস হরতালকে প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে তার নমুনা পাওয়া যায় সংসদে পরিবেশ ও বন প্রতিমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের তেল-গ্যাস রক্ষা কমিটির নেতাদের নামে অশোভন ভাষায় মিথ্যাচার ও কুৎসা রটনা করা দেখে। শুধু হাছান মাহমুদই নন, সরকারদলীয় অনেকেই এ কমিটির বিরুদ্ধে কটূক্তি করেছেন। হরতালের দিন পুরো স্টিমরোলার চালিয়েছে হরতালকারীদের ওপর। যার ছবি দেশবাসী পত্রপত্রিকা এবং স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল মারফত দেখতে পেয়েছেন। এ দেশে ন্যায্য দাবি আদায়ের আন্দোলনে শাসকশ্রেণী বরাবরই পেটোয়া বাহিনীকে দিয়ে নির্বিচারে নির্যাতন চালিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো- সরকার ‘টোকাইদের’ ডাকা হরতালকে এতটা ভয় পেল কেন? তেল-গ্যাস রক্ষা কমিটি চুক্তির বিরোধিতা করছে। চুক্তিতে এমন কী আছে যার জন্য এই বিরোধিতা- সেটা সরকার চাইলেই খোলাসা করতে পারত। সরকার যখন এতই দেশদরদি তখন তারা হিসাব কষে দেখাক, অর্ধদিবস হরতালে দেশের কতটুকু ক্ষতি হয়েছে, আর চুক্তি করে দেশ কতটা লাভবান হয়েছে। অবশ্য সরকার তো জনমতের তোয়াক্কা করে না। যদি করত তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রাখা উচিত কি না- এ প্রসঙ্গে জনমত যাচাই করে সিদ্ধান্ত নিতে পারত। তা করেনি। সরকার সংঘাতের মুখেই দেশকে ঠেলে দিচ্ছে। আগামী ৬ ও ৭ জুলাই আবারও বিএনপির ৪৮ ঘণ্টার হরতাল ডাকা সে সাক্ষ্যই দেয়।

পরিশেষে বলব, ‘মেঘ দেখে কেউ করিসনে ভয়, আড়ালে তার সূর্য হাসে’- প্রচলিত বাক্যটি অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলেও বাংলাদেশের রাজনীতিতে তা অনেকটাই ম্রিয়মাণ। এ কথা অনস্বীকার্য, দেশের প্রধান দুটি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনৈতিক অনৈক্যের কারণেই ওয়ান-ইলেভেনের সৃষ্টি হয়েছিল। ওয়ান-ইলেভেন-পরবর্তী দুই বছরে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীদের ওপর যে নির্যাতন চলেছিল তাতে মনে হয়েছিল এটা থেকে দুটি দলই শিক্ষা নেবে এবং ভবিষ্যতের জন্য দেশের স্বার্থে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে যাবে। কিন্তু সে আশার গুড়ে বালি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন