মঙ্গলবার, ৩ জুলাই, ২০১৮

রাজনীতি : রাজনৈতিক সংকট প্রশ্নের উত্তর ডিসেম্বরে

দিক দিগন্ত, ঢাকা

অনেকগুলো প্রশ্ন নিয়ে সামনে এগুচ্ছে বাংলাদেশ। সব প্রশ্নের উত্তরও নির্ভর করছে আগামী ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ওপর। সংকটের উত্তরণ সহসাই হচ্ছে না- এটা পরিষ্কার। যদিও ইতোমধ্যে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং তার বড়ো ছেলে তারেক রহমান জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাও অনেক আগে প্যারোলে মুক্তি হয়ে দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। আবার এদের মুক্তি নিয়েও শুরু হয়েছে নানা গুঞ্জন।

বিএনপি সমর্থকরা খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানের মুক্তিকে দেখছেন রাজনৈতিক জয় হিসেবে। তাদের মতে, মা ও ছেলে আইনি প্রক্রিয়ায় সব মামলায় জামিন পেয়ে মুক্ত হয়েছে। অপরদিকে শেখ হাসিনা প্যারোলে মুক্ত আছেন। এবং তার এ মুক্ত হওয়াতে সরকারি আঁতাত রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তবে তাদের মুক্তি আইনি প্রক্রিয়ায় হোক কিংবা সরকারি আঁতাতেই হোক- এ প্রশ্নটি দেশবাসীর কাছে বড়ো বিষয় নয়।
বড়ো বিষয় হচ্ছে দুটি বছর যে সংকটের মধ্য দিয়ে দেশবাসীকে পার করতে হয়েছে সে সংকটের উত্তরণ আগামী জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে হবে কিনা? যদিও ইতোপূর্বে অনেক পত্রপত্রিকায় বর্তমান সরকারের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা এবং আগামী সরকারের মেয়াদ কতোদিন হতে পারে তা নিয়ে বিস্তর লেখা হয়েছে। পক্ষে-বিপক্ষে নানান যুক্তিও তুলে ধরা হয়েছে। তা থেকে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের চিত্র কেমন হতে পারে সে বিষয়ে যথার্থ ধারণা পাওয়া যায়। একই সঙ্গে আরেকটি বিষয় স্পষ্ট হয় যে, বর্তমান সংকটে নীতি নির্ধারকদের কিছুই করার নেই। তারা মূলত একজনের সিদ্ধান্তেই কাজ করে থাকেন। আর তাই আগামী সরকারের ধরন কি হতে পারে, সরকারের কাঠামো কেমন হতে পারে, সে কাঠামোতে কারা কারা থাকতে পারেন এসব সম্পর্কে যথেষ্ট অনুমানও পাওয়া যায়।
বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ৯০ দিন পরবর্তী অর্থাৎ বাকি ২১ মাস সময়ের সাংবিধানিক বৈধতা কিভাবে পাবে, আগামী নির্বাচন আদৌ সুষ্ঠু হবে কিনা এসব নিয়ে এখন হরহামেশাই আলোচনা হচ্ছে। বলতে গেলে দেশের প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনৈতিক আলোচনার চেয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাংবিধানিক বৈধতার প্রশ্নটি বেশ জোরেশোরেই আলোচিত হচ্ছে। অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন- দেশ ওয়ান ইলেভেনের আগে ভালো ছিল, না এখন ভালো আছে?
অবশ্য এর উত্তর দেশের জনসাধারণ সময়মতো দেবেন। তবে বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার মুখে উন্নয়নের অনেক কথা বললেও এই একটি ব্যাপারে অর্থাৎ সাংবিধানিক বৈধতার বিষয়ে তাদের পক্ষ থেকে পরিষ্কার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। বলতে পারেনি মেয়াদ উত্তীর্ণ সময়ের কর্মকা-ের বৈধতার বিষয়টি কিভাবে নির্ধারিত হবে। এক্ষেত্রে তারা বরাবরই থেকেছে নিষ্ক্রিয়। বুক ফুলিয়ে ঘোষণা দিয়েছে আগামী বছর জাতি একটি সুন্দর সরকার পাবে। কিন্তু সে সুন্দরের ধরন কেমন হবে তা তারা বলতে পারছেন না।
সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাদের নিজেদের কর্মকা-ের বৈধতা পাওয়ার জন্য নামকাওয়াস্তে একটি নির্বাচনের আয়োজন এবং সে নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের আজ্ঞাবহ একটি পুতুল সরকার বানাতেই পারেন। তারপর নির্বাচিত সে সরকারের মাধ্যমে সাংবিধানিক বৈধতা আদায় করে বুক ফুলিয়ে বিদায় নেবেন। এমনটি ঘটলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। কেননা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সামনে এর চেয়ে আর কি বিকল্প থাকতে পারে।
গলাবাজি যতোই করুক না কেন, দিন যতোই গড়াচ্ছে ততোই তারা বুঝতে পারছে যে, ৯০ দিন পরবর্তী সময় কর্মকা-ের সাংবিধানিক বৈধতা নির্বাচিত সরকারের কাছ থেকেই আদায় করতে হবে। আর এ বৈধতা মিলতে পারে একমাত্র নিজেদের আজ্ঞাবহ সরকারের কাছ থেকে। কেননা মাইনাস টু ফর্মুলার নামে দেশের শীর্ষ দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে ভাঙনের প্রক্রিয়া তারা চালিয়েছিলেন তা সফল হতে পারেনি। আর পারেনি বলেই এখন তাদের সঙ্গে ম্যানেজ টু ফর্মুলায় এগুচ্ছেন। দুর্নীতি মামলায় রাজনৈতিক দল দুটির নেতাদের একের পর এক জামিন পেয়ে যাওয়া এর যথার্থ উদাহরণ।
ম্যানেজ টু ফর্মুলার লক্ষ্য আজ্ঞাবহ একটি স্বল্পমেয়াদি সরকার বানানো। তার মহড়া হিসেবেই চার সিটি করপোরেশন ও ৯টি পৌরসভায় নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। এরপর করতে যাচ্ছে উপজেলা নির্বাচন। যদিও সংসদের আগে উপজেলা নির্বাচনের বিরোধিতা করেছে প্রধান দলগুলো।
বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির জাঁতাকলে পিষ্ঠ জনগণ অপেক্ষা করছেন একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে কোনো রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসুক। একটি রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসার মধ্য দিয়ে এই দুঃসহনীয় পরিস্থিতি থেকে মুক্তি মিলতে পারে। যদিও এ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে জনগণকে বারবারই ধোঁকা খেতে হয়েছে রাজনৈতিক সরকারের কাছ থেকে।
আর তাই আগামী ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে আর যাই হোক জনগণের সার্বিক মুক্তি সহসাই আসবে না। মুক্তির জন্য দেশবাসীকে কতোদিন অপেক্ষা করতে হবে তা প্রশ্নসাপেক্ষ। অনুষ্ঠিতব্য ওই নির্বাচনের মাধ্যমে যদি আজ্ঞাবহ সরকার গঠন করা হয় তবে জনগণের জীবনে আরো বেশি অমানিশার ঘোর অন্ধকারই বয়ে আসতে পারে। এ অবস্থায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কোথায় গিয়ে ঠেকতে পারে তা অনুমান করাও কঠিন। তাছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারও তেমন জোরালো কোনো যুক্তি দিয়ে বোঝাতে পারবে না।
দ্রব্যমূল্য হু হু করে বেড়ে কেনই বা তিনচার গুণ বেশি হয়েছে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির একটি পর্যায় থাকতে পারে। হতে পারে তা ধাপে ধাপে। কিন্তু এক ধাপে তিনচার গুণ বেশি বাড়ার রেকর্ডের দাবিদার একমাত্র এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার। অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে পণ্যমূল্যের নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন তারা। সরকার বলতে পারবে না, বোরোর বাম্পার ফলনের পরও কেন বেশি টাকা দিয়ে চাল কিনে খেতে হচ্ছে?
আগামী নির্বাচিত সরকার নিত্যপণ্যের দাম আগের জায়গায় নিয়ে যেতে পারবে কি? অতীত কিন্তু এর পক্ষে কোনো সাক্ষ্য দেয় না। আর এও বলা মুশকিল যে, দেশের সাধারণ মানুষ ওয়ান ইলেভেনের পর সত্যিকার অর্থেই মুক্তি পেয়েছেন নাকি আরো বেশি শোষণের জাঁতাকলে পিষ্ঠ হচ্ছেন? কারণ জনগণ এখন নীরব ভূমিকা পালন করছেন। আবার আগের মতো সরকারের মুখ থেকেও আশা জাগানিয়া শব্দ বের হচ্ছে না। সরকারের নীরবতায় বলে দেয় আগামী নির্বাচনে তারা এ ধরনের সরকার গঠনের দিকেই যাচ্ছেন।
তবে এ কথা সত্য যে দিন যতোই যাচ্ছে বর্তমান সরকারের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। আর এ অনিশ্চয়তার কারণেই আগামী নির্বাচনে তাদের আজ্ঞাবহ সরকার গঠন করার তাগিদও বাড়ছে। আগামী জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে স্বল্পমেয়াদি না পূর্ণমেয়াদি সরকার গঠিত হবে তার উত্তরের জন্য দেশবাসীকে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

[বি. দ্র. লেখাটি ‘দিক দিগন্ত’ নামে একটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল; কিন্তু সেটি সাপ্তাহিক না পাক্ষিক ছিল মনে নেই। মুদ্রিত সংখ্যা পেলে প্রকাশের তারিখ এবং তা উল্লেখ করা হবে]

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন