১৩ অক্টোবর, ২০০৪
আজ ১৩ অক্টোবর নাচোলের তেভাগা অর্থাৎ সাঁওতাল আন্দোলনের বিখ্যাত নেত্রী ইলা মিত্রের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। ২০০২ এর ১৪ অক্টোবর সকালে ঘুম ভেঙেছিল তাঁর মৃত্যুর খবর শুনে। মর্মাহত হয়েছিলাম। মর্মাহত হয়েছিলাম এজন্য যে, এই মহিয়সী নারীকে নিয়ে তথা তেভাগা আন্দোলন সম্পর্কে কাজ করার মানসে বই-পুস্তক জোগাড় করা শুরু করেছিলাম। ইচ্ছে ছিল তাঁর সাক্ষাতের মধ্য দিয়ে কাজটা শুরু করবো। তা আর হয়নি। সে কাজ শুরুর আগেই তিনি এ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন।
নাচোলের তেভাগা আন্দোলনের ইতিহাসে উজ্জ্বল এই মহিয়সী নারী ইলা মিত্র ‘রানীমাৎ উপাধি পেয়েছিলেন। তাঁর দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে আজ একটার পর একটা স্মৃতি যেন মানসপটে ভেসে উঠছে। আমার দুঃখ এখানেই যে, এই মহিয়সী নারীর সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ পেয়েও করতে পারিনি। তার ব্যাখ্যায় পরে আসছি। তার আগে তাঁকে নিয়ে নাচোলে কিছু করার কথা বলবো। তেভাগা আন্দোলন নিয়ে অনেক লেখা হয়েছে। আজ আর আন্দোলন প্রসঙ্গে যাবো না। এ লেখাটি নিতান্তই ব্যক্তিগত অনুভূতি থেকে।
জন্মের পর থেকে এসএসসি পরীক্ষা অর্থাৎ ১৯৯২ সাল পর্যন্ত শিবগঞ্জে নানির বাড়িতেই থাকতাম। তখন পর্যন্ত নাচোলের তেভাগা আন্দোলন তথা ইলা মিত্র সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য আমার জানা ছিলো না। শুধু জানা ছিলো নাচোলে একসময় সাঁওতাল আন্দোলন হয়েছিলো। ওটুকুই। এসএসসি পাস করার পর চলে আসি বাবা-মার কাছে। ভর্তি হই নাচোল কলেজে। এরপর বাবার মুখে তেভাগা আন্দোলন সম্পর্কে বিস্তারিত জানার পর রানীমার প্রতি আলাদা ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধাবোধ তৈরি হয়। কেবলই মনে হতো একজন নারী অবর্ণনীয় নির্যাতন সহ্য করে কিভাবে টিকে ছিলেন! সত্যিই ভাবার বিষয়। তাঁর মরদেহটাকে মেডিকেল কলেজে দান করে আবারও প্রমাণ করে গেছেন সত্যিই তিনি মহিয়সী।
দেশের প্রতিটি স্থানেরই কিছু না কিছু ইতিহাস ঐতিহ্য থেকে থাকে। সেরূপ নাচোলের তেভাগা আন্দোলনের ইতিহাস যুগ যুগ ধরে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকবে। আর সেই ইতিহাসের উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে ইলা মিত্রের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
নাচোলে থাকবার আগ পর্যন্ত যেমন এ নিয়ে কারো মাথা ব্যথা দেখিনি পরেও কাউকে দেখিনি। এই না দেখাটা নিজের কাছেই যেন অপরাধবোধ হয়ে দাঁড়ায়। এ অপরাধবোধ থেকেই সে সময় প্রতিনিয়ত কিছু করার চিন্তায় ঘুরপাক করতাম কি করা যায়? একসময় ভাবতে শুরু করি রানীমার নামে কোন সংগঠন দাঁড় করানো যায় কিনা। যে সংগঠনের উদ্দেশ্য থাকবে সমাজ সেবামূলক কাজ করার। কিন্তু নাচোলবাসীর অধিকাংশেরই এমনকি শিক্ষিত এবং সচেতন মানুষেরও আন্দোলন সম্পর্কে যে নেতিবাচক মনোভাব সেখানে তেভাগা আন্দোলনের নেত্রী ইলা মিত্রকে নিয়ে কিছু করবার চিন্তাটা বেশ কষ্টকর হয়েই পড়ে। অনেকের ধারণা রানীমাকে নিয়ে কোন সংগঠন দাঁড় করালে পুনরায় হয়তো বা তেভাগা আন্দোলনই না শুরু হয়ে যায়।
অনেক দৌড়ঝাঁপ করে উপদেষ্টা কিংবা সহযোগী হিসেবে পাই নাচোল কলেজের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক জনাব গোলাম মোস্তফাকে। তাকে নিয়ে প্রাথমিক কাজ শুরু। এবং ১৯৯৫ সালে (সঠিক তারিখটা উল্লেখ করতে পারলাম না বর্তমানে ঢাকায় অবস্থান করায়) নাচোলের সুধীজন এবং কিছু তরুণদের নিয়ে একটা মিটিং আহ্বান করি। কিন্তু প্রথম মিটিংটি ছিলো সুপার ফ্লপ।
দ্বিতীয়বার আবারও মিটিং আহ্বান করি। এবার কিছুটা আশানুরূপ সাড়া পাই। সেদিনই ‘ইলা মিত্র স্মৃতি সংসদ’ নাম ঠিক করে একটি কমিটি গঠন করা হয়। যার সভাপতি হিসেবে অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা এবং সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নাচোল কলেজের ছাত্র গোলাম মর্তুজাকে মনোনীত করা হয়। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিলেন ইলা মিত্র জীবিত থাকাবস্থায় আবার স্মৃতি সংসদ কেন? উত্তর ছিলো- ইলা মিত্র জীবিত থাকলেও নাচোলবাসীর কাছে তিনি স্মৃতি। অবশ্য এরপরের বছর অর্থাৎ ১৯৯৬ সালেই রানীমা নাচোলে আসেন।
‘ইলা মিত্র স্মৃতি সংসদ’ গঠন হবার পর নতুন উদ্যমে কাজ শুরু হবার কথা থাকলেও শুরু হয়নি। কমিটি হবার পর সবাই কেমন জানি চুপসে গেলেন। এরপর শ্রদ্ধেয় শিক্ষক গোলাম মোস্তফা এবং আমরা তিনজন মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম কলেজ পর্যায়ে রচনা প্রতিযোগিতা করার। ১০ জন প্রতিযোগী এতে অংশ নেয়।
ঘোষণা অনুযায়ী ১০ জন প্রতিযোগীর মধ্যে ১ম, ২য় ও ৩য় স্থানের পাশাপাশি সকলকে সান্ত¦না পুরস্কার ও সনদপত্র বিতরণ উপলক্ষে আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য তোড়জোড় শুরু করি। আমি, নয়ন রাজশাহী যাই কম্পিউটারে সনদপত্র করার জন্য। রাজশাহী গিয়ে নাদিমকে সঙ্গে নিয়ে সাপ্তাহিক গণখবর সম্পাদক মাহতাব কাকুর কাছে তার কম্পিউটারে সনদপত্র করে দেবার জন্য বললে, বিস্তারিত শোনার পর তিনি বললেন, ‘আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষককে অতিথি হিসেবে নিয়ে যাব।’ আমি এ কথা শুনে থ মেরে গেলাম। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ কি যাবেন আমাদের অনুষ্ঠানে? যা হোক, মাহতাব কাকুর নির্দেশ অনুযায়ী নয়নকে নাচোল পাঠিয়ে দিলাম কার্ড না ছাপাবার জন্য। সন্ধ্যার পর আমি, নাদিম ও মাহতাব কাকু গেলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কোয়ার্টারে। প্রথমেই গেলাম প্রখ্যাত কথা সাহিত্যিক, দর্শন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জনাব হাসান আজিজুল হকের বাসায়। উনি সংগঠনের নাম শুনে সানন্দেই রাজি হলেন নাচোল যাবার জন্য। হাসান স্যারের বাসা থেকে বেরিয়ে গেলাম প্রাবন্ধিক ফলিত রসায়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শহিদুল ইসলামের বাসায়। তিনিও সানন্দে রাজি হলেন। রাজি হলেন কবি, সাহিত্যিক, বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জনাব জুলফিকার মতিনও।
যা হোক, অনুষ্ঠানের দিন যতই ঘনিয়ে আসছিলো মনের মধ্যে কেবল ভয়ই বাড়ছিলো- অতিথিদের সম্মান রক্ষা করতে পারবো তো? কেননা এতো বড় মাপের মানুষ নাচোলে আসছেন আমার মাধ্যমে। সেক্ষেত্রে ভয় পাওয়াটা খুবই স্বাভাবিক ছিলো।
নির্ধারিত দিনে যথারীতি সকাল ১০টায় অনুষ্ঠান শুরু হবার কথা। কিন্তু অতিথিবৃন্দের একটু দেরিতে আসার কারণে অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিলো সাড়ে ১১টার দিকে। এই দেড় ঘণ্টা সময় ধৈর্য ধরে বসে থাকা উপস্থিত ছাত্র শিক্ষকদের পক্ষে সম্ভব ছিলো না। তাই অনেকেই চলে গিয়েছিলেন। মঞ্চের সামনে সবমিলিয়ে হয়তো ৬০ থেকে ৭০ জন উপস্থিত ছিলেন। ভেতরে প্রচ- এক ধরনের লজ্জা, বলা যায় এক ধরনের কষ্ট অনুভব করছিলাম। যোগ্য ব্যক্তিদের মর্যাদাটুকুও জানাতে পারলাম না। কিন্তু শ্রদ্ধেয় হাসান স্যার আমার কষ্টটাকে ভুলিয়ে দিলেন। দেরিতে আসার জন্য উপস্থিত জনের কাছে ক্ষমা স্বীকার করে। কিন্তু আমাদের বাসায় দুপুরের খাবার সময় হাসান স্যার বললেন, তৌহিদ, এ ধরনের অনুষ্ঠান করার জন্য খুব খুশি হয়েছি। তুমি প্রতিবছরই এটা করার চেষ্টা করবে। প্রয়োজনে আমি ঢাকা থেকে অন্যদেরকেও নিয়ে আসবো।’
অনুষ্ঠানের পর থেকে একটানা অক্টোবর মাস পর্যন্ত বাড়ির বাইরে খুব কমই বের হয়েছি। একদিন মেহের কাকা বাসায় এসে খবর দিলেন, ‘তৌহিদ রাজশাহী থেকে ফজলে হোসেন বাদশা নাচোল আসছেন, তোমাকে দেখা করতে বলেছেন।’ মেহের কাকার কথানুযায়ী বিকেলে নাচোল কলেজে গেলাম বাদশা ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে। তাঁর সাথে আমার সেদিনই প্রথম সাক্ষাৎ হয়। তিনি আমাকে বলেন, ‘তোমার কথা আমি শুনেছি। ইলাদিকে নিয়ে কাজ করছো এটাও জেনেছি। তোমার জন্য খুশির খবর হলো- ইলাদিকে তোমার কথা বলেছি এবং ইলাদি নাচোল আসতে চাচ্ছেন।’ তিনি বললেন, ‘কয়েকদিন পরে আমি কলকাতা যাবো, তখন তারিখ নির্ধারণ করে এসে তোমাকে জানাবো।’
এরপর সত্যিই ইলা মিত্রের নাচোল আসার নির্ধারিত তারিখ ঠিক করে বাদশা ভাই নাচোল আসলেন। রানীমার আগমন উপলক্ষে কমিটি হলো। কমিটির আহ্বায়ক হলেন জেলা জাসদের সহসভাপতি মেহের আলী। কমিটির নাম দেয়া হলো ‘তেভাগা কৃষক আন্দোলনের ৫০ বছর পূর্তি উদযাপন কমিটি’। কমিটি থেকে আমাকে পত্রিকা প্রকাশের দায়িত্ব দেয়া হলো। বাদশা ভাইকে পত্রিকার বাজেট দিলাম ৮ হাজার টাকা। বাদশা ভাই জানালেন, ‘কাজ শুরু করে দাও। টাকা পাবা। আর তোমার তেভাগা আন্দোলন কিংবা রানীমা সম্পর্কিত কোন লেখা থাকলে দাও। সোনালী সংবাদে (রাজশাহীর দৈনিক) ছাপাবো। আমার একটা লেখা ছিলো। সেটা দিলাম। যথারীতি সোনালী সংবাদে সেটা ছাপা হয়েছিলো। শুরু করলাম পত্রিকার জন্য দৌড়াদৌড়ি। সময় কম। মাত্র ১৫ দিন। এর মধ্যেই লেখা সংগ্রহ করতে হবে। লেখা সংগ্রহের আগে ভাবলাম পত্রিকার সম্পাদক কাকে করা যায়? এমন একজনকে সম্পাদক করতে হবে যাকে নিয়ে দৌড়ঝাঁপ করা যায়। হঠাৎ করেই মনের মধ্যে উদয় হলো নাচোল কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রভাষক জনাব অজিত কুমার দাসের কথা। তিনি আমার শিক্ষক ছিলেন না। কিন্তু জুনিয়র অনেক ছাত্র ছাত্রীর মুখে তার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা শুনেছি।
তখন পর্যন্ত অজিত স্যারের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়নি। কাজেই নাচোল কলেজ থেকে ঠিকানা নিয়ে আমি, নাদিম দৌড় লাগালাম গোমস্তাপুর স্যারের বাসায়। স্যার সানন্দে রাজি হলেন। সমস্ত লেখা সংগ্রহ করে গণখবর সম্পাদক মাহতাব কাকুর কাছে হাজির হই। তিনি পত্রিকা ছাপার ব্যবস্থা করলেন। যা হোক, পত্রিকার কম্পোজ শেষ। নাম ঠিক করা হলো নাচোলে ইলা মিত্র। কিন্তু পত্রিকা প্রকাশের জন্য নির্ধারিত ৮ হাজার টাকার মধ্যে ৮টা টাকাও পেলাম না পত্রিকা প্রকাশের আগে। কথা হলো, পত্রিকা ছাপাও টাকা পাবা। কিন্তু এ কথায় সন্তুষ্ট হতে পারিনি। তবে পত্রিকা করার যখন দায়িত্ব নিয়েছি তখন পত্রিকা প্রকাশ করবোই। কম্পোজ, ট্রেসিং মাহতাব কাকু করে দিলেও ছাপা খরচ, কাগজ, বাইন্ডিং অনেক কিছুই থেকে যায়। অজিত স্যার জানালেন তার কাছে ২ রিম কাগজ আছে, সেটা দিয়ে দিতে পারেন। তা দিয়ে ইনার পেজ ছাপাবার ব্যবস্থা হলেও কভার ছাপা বাকি। অগত্যা স্যার গেলেন কয়েকটা বিজ্ঞাপন সংগ্রহের জন্য। পেয়েছিলামও কয়েকটা বিজ্ঞাপন, যে টাকা দিয়ে কভার ছাপানো হয়েছিলো।
এরপর এলো সেই নির্ধারিত তারিখ ৬ নভেম্বর। সেদিনই রাজশাহী থেকে পত্রিকা নিয়ে নাচোল গিয়েছিলাম। সভা শুরু হবে ৩টার দিকে। কাজেই দুপুরের আগ পর্যন্ত আমি, নাদিম, নয়ন এবং বাসার নাচোলের এদিক সেদিক পত্রিকা বিক্রি করলাম। বেশ কিছু বিক্রি হয়েছিলো তবে বেশি বিক্রি হয়েছিলো সভা চলাকালীন সময়ে। ছাপানো ৫০০ কপিই শেষ। মানুষের ব্যাপক চাহিদা সত্ত্বেও তাদের হাতে তুলে দিতে পারিনি। যেখানে সিদ্ধান্ত ছিলো ১০০০ কপি ছাপানোর, সেখানে নিজেদের পকেট থেকে কোনরকমে ৫০০ কপি ছাপিয়ে নাচোল গিয়েছিলাম। অবশ্য সব কপি শেষ হয়ে যাবার ফলে বিক্রীত টাকা দিয়ে পত্রিকা রিপ্রিন্ট করেছিলাম পরদিন নবাবগঞ্জের সভায় বিক্রি করার জন্য। নাচোলের ৬ নভেম্বর জনসভায় সেদিন মানুষের ঢল নেমেছিলো। হাজার হাজার সাঁওতাল ছাড়াও বাইরের অনেক মানুষের সমাগমে মুখরিত হয়েছিল নাচোল কলেজ মাঠ। তিল ধারণের জায়গাটুকু পর্যন্ত ছিলো না। রানীমাকে দেখার জন্য সেদিন যত লোক সমাগম হয়েছিল তার আগের বছর অর্থাৎ ১৯৯৫ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ঐ নাচোল কলেজ মাঠের জনসভাতেও এতো লোক হয়নি। বিকেল ৪টার দিকে মঞ্চে আসলেন বিপ্লবী নেত্রী ইলা মিত্র। খুব কাছ থেকেই তাঁকে দেখলাম। দেখলাম বয়স তাঁকে চেপে ধরেছে। নিজ হাতে তাকে পত্রিকা দিলাম। দিলাম উপহার হিসেবে একটি ওয়ালমেট। কিন্তু অনুষ্ঠানে ‘ইলা মিত্র স্মৃতি সংসদ’কে মঞ্চে তুলে ধরার কথা থাকলেও তা করা হয়নি। পত্রিকার নির্ধারিত বাজেটের ৮ হাজার টাকার মধ্যে ৮০ পয়সাও পাইনি। বরং কমিটির আহ্বায়ককে সভা আয়োজনের জন্য পত্রিকা বিক্রির টাকা দিয়েছিলাম। পরদিন ৭ নভেম্বর নবাবগঞ্জ সার্কিট হাউজে ইলা মিত্রের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলেন অজিত স্যার, নাদিম ও বাসার। কিন্তু দুঃখ আমার আমি যেতে পারিনি। সাক্ষাৎ করতেও পারিনি। তার ১ দিন পর পরীক্ষা থাকার কারণে। তাঁর সাথে আমার স্মৃতি বলতে নাচোল মঞ্চে তাঁর হাতে পত্রিকা এবং উপহার হিসেবে ওয়ালমেট তুলে দেয়া ওটুকুই। আমি বেঁচে থাকা পর্যন্ত এটুকু স্মৃতি সবসময় আমার কাছে জমা হয়ে থাকবে।
আজ ইলা মিত্রের মৃত্যু দিনে এ লেখায় অনেক কথাই বলে ফেললাম। বলা এজন্য যে, তাঁর নাচোল আসার পেছনে ইলা মিত্র স্মৃতি সংসদের হাসান স্যারদের নিয়ে করা অনুষ্ঠানটির বড় ভূমিকা ছিলো। কিন্তু সেটুকুর মূল্যায়ন করা হয়নি সংসদের প্রতি।
আজ ইলা মিত্রের মৃত্যু দিনে এ স্মৃতিগুলোই বার বার ভেসে উঠছিলো। হাসান আজিজুল হক স্যার এখনও নাচোল যান। ইলা মিত্রের মৃত্যুর পরের দিন তিনি এবং কয়েকজন গিয়ে শহীদ বেদীতে পুষ্পস্তবক দিয়ে আসেন। তাছাড়া এখন তাঁকে নিয়ে অনেকে উৎসাহী হয়ে কাজ করছেন। এখন দু’চারটা খবর পাই তাঁকে নিয়ে নাচোলে অনুষ্ঠান করার। অজিত স্যারের মুখে শুনেছি আমার ধারণাগুলো নিয়ে একটি এনজিও কাজ শুরু করতে যাচ্ছে। ভালোই তবে আমার সঙ্গে এখনও যোগাযোগ হয়নি। যাহোক, এটুকু তো বলা যায়, কাজ শুরু হলে কেউ না কেউ তা শেষ করবে।
জন্মের পর থেকে এসএসসি পরীক্ষা অর্থাৎ ১৯৯২ সাল পর্যন্ত শিবগঞ্জে নানির বাড়িতেই থাকতাম। তখন পর্যন্ত নাচোলের তেভাগা আন্দোলন তথা ইলা মিত্র সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য আমার জানা ছিলো না। শুধু জানা ছিলো নাচোলে একসময় সাঁওতাল আন্দোলন হয়েছিলো। ওটুকুই। এসএসসি পাস করার পর চলে আসি বাবা-মার কাছে। ভর্তি হই নাচোল কলেজে। এরপর বাবার মুখে তেভাগা আন্দোলন সম্পর্কে বিস্তারিত জানার পর রানীমার প্রতি আলাদা ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধাবোধ তৈরি হয়। কেবলই মনে হতো একজন নারী অবর্ণনীয় নির্যাতন সহ্য করে কিভাবে টিকে ছিলেন! সত্যিই ভাবার বিষয়। তাঁর মরদেহটাকে মেডিকেল কলেজে দান করে আবারও প্রমাণ করে গেছেন সত্যিই তিনি মহিয়সী।
দেশের প্রতিটি স্থানেরই কিছু না কিছু ইতিহাস ঐতিহ্য থেকে থাকে। সেরূপ নাচোলের তেভাগা আন্দোলনের ইতিহাস যুগ যুগ ধরে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকবে। আর সেই ইতিহাসের উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে ইলা মিত্রের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
নাচোলে থাকবার আগ পর্যন্ত যেমন এ নিয়ে কারো মাথা ব্যথা দেখিনি পরেও কাউকে দেখিনি। এই না দেখাটা নিজের কাছেই যেন অপরাধবোধ হয়ে দাঁড়ায়। এ অপরাধবোধ থেকেই সে সময় প্রতিনিয়ত কিছু করার চিন্তায় ঘুরপাক করতাম কি করা যায়? একসময় ভাবতে শুরু করি রানীমার নামে কোন সংগঠন দাঁড় করানো যায় কিনা। যে সংগঠনের উদ্দেশ্য থাকবে সমাজ সেবামূলক কাজ করার। কিন্তু নাচোলবাসীর অধিকাংশেরই এমনকি শিক্ষিত এবং সচেতন মানুষেরও আন্দোলন সম্পর্কে যে নেতিবাচক মনোভাব সেখানে তেভাগা আন্দোলনের নেত্রী ইলা মিত্রকে নিয়ে কিছু করবার চিন্তাটা বেশ কষ্টকর হয়েই পড়ে। অনেকের ধারণা রানীমাকে নিয়ে কোন সংগঠন দাঁড় করালে পুনরায় হয়তো বা তেভাগা আন্দোলনই না শুরু হয়ে যায়।
অনেক দৌড়ঝাঁপ করে উপদেষ্টা কিংবা সহযোগী হিসেবে পাই নাচোল কলেজের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক জনাব গোলাম মোস্তফাকে। তাকে নিয়ে প্রাথমিক কাজ শুরু। এবং ১৯৯৫ সালে (সঠিক তারিখটা উল্লেখ করতে পারলাম না বর্তমানে ঢাকায় অবস্থান করায়) নাচোলের সুধীজন এবং কিছু তরুণদের নিয়ে একটা মিটিং আহ্বান করি। কিন্তু প্রথম মিটিংটি ছিলো সুপার ফ্লপ।
দ্বিতীয়বার আবারও মিটিং আহ্বান করি। এবার কিছুটা আশানুরূপ সাড়া পাই। সেদিনই ‘ইলা মিত্র স্মৃতি সংসদ’ নাম ঠিক করে একটি কমিটি গঠন করা হয়। যার সভাপতি হিসেবে অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা এবং সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নাচোল কলেজের ছাত্র গোলাম মর্তুজাকে মনোনীত করা হয়। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিলেন ইলা মিত্র জীবিত থাকাবস্থায় আবার স্মৃতি সংসদ কেন? উত্তর ছিলো- ইলা মিত্র জীবিত থাকলেও নাচোলবাসীর কাছে তিনি স্মৃতি। অবশ্য এরপরের বছর অর্থাৎ ১৯৯৬ সালেই রানীমা নাচোলে আসেন।
‘ইলা মিত্র স্মৃতি সংসদ’ গঠন হবার পর নতুন উদ্যমে কাজ শুরু হবার কথা থাকলেও শুরু হয়নি। কমিটি হবার পর সবাই কেমন জানি চুপসে গেলেন। এরপর শ্রদ্ধেয় শিক্ষক গোলাম মোস্তফা এবং আমরা তিনজন মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম কলেজ পর্যায়ে রচনা প্রতিযোগিতা করার। ১০ জন প্রতিযোগী এতে অংশ নেয়।
ঘোষণা অনুযায়ী ১০ জন প্রতিযোগীর মধ্যে ১ম, ২য় ও ৩য় স্থানের পাশাপাশি সকলকে সান্ত¦না পুরস্কার ও সনদপত্র বিতরণ উপলক্ষে আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য তোড়জোড় শুরু করি। আমি, নয়ন রাজশাহী যাই কম্পিউটারে সনদপত্র করার জন্য। রাজশাহী গিয়ে নাদিমকে সঙ্গে নিয়ে সাপ্তাহিক গণখবর সম্পাদক মাহতাব কাকুর কাছে তার কম্পিউটারে সনদপত্র করে দেবার জন্য বললে, বিস্তারিত শোনার পর তিনি বললেন, ‘আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষককে অতিথি হিসেবে নিয়ে যাব।’ আমি এ কথা শুনে থ মেরে গেলাম। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ কি যাবেন আমাদের অনুষ্ঠানে? যা হোক, মাহতাব কাকুর নির্দেশ অনুযায়ী নয়নকে নাচোল পাঠিয়ে দিলাম কার্ড না ছাপাবার জন্য। সন্ধ্যার পর আমি, নাদিম ও মাহতাব কাকু গেলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কোয়ার্টারে। প্রথমেই গেলাম প্রখ্যাত কথা সাহিত্যিক, দর্শন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জনাব হাসান আজিজুল হকের বাসায়। উনি সংগঠনের নাম শুনে সানন্দেই রাজি হলেন নাচোল যাবার জন্য। হাসান স্যারের বাসা থেকে বেরিয়ে গেলাম প্রাবন্ধিক ফলিত রসায়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শহিদুল ইসলামের বাসায়। তিনিও সানন্দে রাজি হলেন। রাজি হলেন কবি, সাহিত্যিক, বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জনাব জুলফিকার মতিনও।
যা হোক, অনুষ্ঠানের দিন যতই ঘনিয়ে আসছিলো মনের মধ্যে কেবল ভয়ই বাড়ছিলো- অতিথিদের সম্মান রক্ষা করতে পারবো তো? কেননা এতো বড় মাপের মানুষ নাচোলে আসছেন আমার মাধ্যমে। সেক্ষেত্রে ভয় পাওয়াটা খুবই স্বাভাবিক ছিলো।
নির্ধারিত দিনে যথারীতি সকাল ১০টায় অনুষ্ঠান শুরু হবার কথা। কিন্তু অতিথিবৃন্দের একটু দেরিতে আসার কারণে অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিলো সাড়ে ১১টার দিকে। এই দেড় ঘণ্টা সময় ধৈর্য ধরে বসে থাকা উপস্থিত ছাত্র শিক্ষকদের পক্ষে সম্ভব ছিলো না। তাই অনেকেই চলে গিয়েছিলেন। মঞ্চের সামনে সবমিলিয়ে হয়তো ৬০ থেকে ৭০ জন উপস্থিত ছিলেন। ভেতরে প্রচ- এক ধরনের লজ্জা, বলা যায় এক ধরনের কষ্ট অনুভব করছিলাম। যোগ্য ব্যক্তিদের মর্যাদাটুকুও জানাতে পারলাম না। কিন্তু শ্রদ্ধেয় হাসান স্যার আমার কষ্টটাকে ভুলিয়ে দিলেন। দেরিতে আসার জন্য উপস্থিত জনের কাছে ক্ষমা স্বীকার করে। কিন্তু আমাদের বাসায় দুপুরের খাবার সময় হাসান স্যার বললেন, তৌহিদ, এ ধরনের অনুষ্ঠান করার জন্য খুব খুশি হয়েছি। তুমি প্রতিবছরই এটা করার চেষ্টা করবে। প্রয়োজনে আমি ঢাকা থেকে অন্যদেরকেও নিয়ে আসবো।’
অনুষ্ঠানের পর থেকে একটানা অক্টোবর মাস পর্যন্ত বাড়ির বাইরে খুব কমই বের হয়েছি। একদিন মেহের কাকা বাসায় এসে খবর দিলেন, ‘তৌহিদ রাজশাহী থেকে ফজলে হোসেন বাদশা নাচোল আসছেন, তোমাকে দেখা করতে বলেছেন।’ মেহের কাকার কথানুযায়ী বিকেলে নাচোল কলেজে গেলাম বাদশা ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে। তাঁর সাথে আমার সেদিনই প্রথম সাক্ষাৎ হয়। তিনি আমাকে বলেন, ‘তোমার কথা আমি শুনেছি। ইলাদিকে নিয়ে কাজ করছো এটাও জেনেছি। তোমার জন্য খুশির খবর হলো- ইলাদিকে তোমার কথা বলেছি এবং ইলাদি নাচোল আসতে চাচ্ছেন।’ তিনি বললেন, ‘কয়েকদিন পরে আমি কলকাতা যাবো, তখন তারিখ নির্ধারণ করে এসে তোমাকে জানাবো।’
এরপর সত্যিই ইলা মিত্রের নাচোল আসার নির্ধারিত তারিখ ঠিক করে বাদশা ভাই নাচোল আসলেন। রানীমার আগমন উপলক্ষে কমিটি হলো। কমিটির আহ্বায়ক হলেন জেলা জাসদের সহসভাপতি মেহের আলী। কমিটির নাম দেয়া হলো ‘তেভাগা কৃষক আন্দোলনের ৫০ বছর পূর্তি উদযাপন কমিটি’। কমিটি থেকে আমাকে পত্রিকা প্রকাশের দায়িত্ব দেয়া হলো। বাদশা ভাইকে পত্রিকার বাজেট দিলাম ৮ হাজার টাকা। বাদশা ভাই জানালেন, ‘কাজ শুরু করে দাও। টাকা পাবা। আর তোমার তেভাগা আন্দোলন কিংবা রানীমা সম্পর্কিত কোন লেখা থাকলে দাও। সোনালী সংবাদে (রাজশাহীর দৈনিক) ছাপাবো। আমার একটা লেখা ছিলো। সেটা দিলাম। যথারীতি সোনালী সংবাদে সেটা ছাপা হয়েছিলো। শুরু করলাম পত্রিকার জন্য দৌড়াদৌড়ি। সময় কম। মাত্র ১৫ দিন। এর মধ্যেই লেখা সংগ্রহ করতে হবে। লেখা সংগ্রহের আগে ভাবলাম পত্রিকার সম্পাদক কাকে করা যায়? এমন একজনকে সম্পাদক করতে হবে যাকে নিয়ে দৌড়ঝাঁপ করা যায়। হঠাৎ করেই মনের মধ্যে উদয় হলো নাচোল কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রভাষক জনাব অজিত কুমার দাসের কথা। তিনি আমার শিক্ষক ছিলেন না। কিন্তু জুনিয়র অনেক ছাত্র ছাত্রীর মুখে তার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা শুনেছি।
তখন পর্যন্ত অজিত স্যারের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়নি। কাজেই নাচোল কলেজ থেকে ঠিকানা নিয়ে আমি, নাদিম দৌড় লাগালাম গোমস্তাপুর স্যারের বাসায়। স্যার সানন্দে রাজি হলেন। সমস্ত লেখা সংগ্রহ করে গণখবর সম্পাদক মাহতাব কাকুর কাছে হাজির হই। তিনি পত্রিকা ছাপার ব্যবস্থা করলেন। যা হোক, পত্রিকার কম্পোজ শেষ। নাম ঠিক করা হলো নাচোলে ইলা মিত্র। কিন্তু পত্রিকা প্রকাশের জন্য নির্ধারিত ৮ হাজার টাকার মধ্যে ৮টা টাকাও পেলাম না পত্রিকা প্রকাশের আগে। কথা হলো, পত্রিকা ছাপাও টাকা পাবা। কিন্তু এ কথায় সন্তুষ্ট হতে পারিনি। তবে পত্রিকা করার যখন দায়িত্ব নিয়েছি তখন পত্রিকা প্রকাশ করবোই। কম্পোজ, ট্রেসিং মাহতাব কাকু করে দিলেও ছাপা খরচ, কাগজ, বাইন্ডিং অনেক কিছুই থেকে যায়। অজিত স্যার জানালেন তার কাছে ২ রিম কাগজ আছে, সেটা দিয়ে দিতে পারেন। তা দিয়ে ইনার পেজ ছাপাবার ব্যবস্থা হলেও কভার ছাপা বাকি। অগত্যা স্যার গেলেন কয়েকটা বিজ্ঞাপন সংগ্রহের জন্য। পেয়েছিলামও কয়েকটা বিজ্ঞাপন, যে টাকা দিয়ে কভার ছাপানো হয়েছিলো।
এরপর এলো সেই নির্ধারিত তারিখ ৬ নভেম্বর। সেদিনই রাজশাহী থেকে পত্রিকা নিয়ে নাচোল গিয়েছিলাম। সভা শুরু হবে ৩টার দিকে। কাজেই দুপুরের আগ পর্যন্ত আমি, নাদিম, নয়ন এবং বাসার নাচোলের এদিক সেদিক পত্রিকা বিক্রি করলাম। বেশ কিছু বিক্রি হয়েছিলো তবে বেশি বিক্রি হয়েছিলো সভা চলাকালীন সময়ে। ছাপানো ৫০০ কপিই শেষ। মানুষের ব্যাপক চাহিদা সত্ত্বেও তাদের হাতে তুলে দিতে পারিনি। যেখানে সিদ্ধান্ত ছিলো ১০০০ কপি ছাপানোর, সেখানে নিজেদের পকেট থেকে কোনরকমে ৫০০ কপি ছাপিয়ে নাচোল গিয়েছিলাম। অবশ্য সব কপি শেষ হয়ে যাবার ফলে বিক্রীত টাকা দিয়ে পত্রিকা রিপ্রিন্ট করেছিলাম পরদিন নবাবগঞ্জের সভায় বিক্রি করার জন্য। নাচোলের ৬ নভেম্বর জনসভায় সেদিন মানুষের ঢল নেমেছিলো। হাজার হাজার সাঁওতাল ছাড়াও বাইরের অনেক মানুষের সমাগমে মুখরিত হয়েছিল নাচোল কলেজ মাঠ। তিল ধারণের জায়গাটুকু পর্যন্ত ছিলো না। রানীমাকে দেখার জন্য সেদিন যত লোক সমাগম হয়েছিল তার আগের বছর অর্থাৎ ১৯৯৫ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ঐ নাচোল কলেজ মাঠের জনসভাতেও এতো লোক হয়নি। বিকেল ৪টার দিকে মঞ্চে আসলেন বিপ্লবী নেত্রী ইলা মিত্র। খুব কাছ থেকেই তাঁকে দেখলাম। দেখলাম বয়স তাঁকে চেপে ধরেছে। নিজ হাতে তাকে পত্রিকা দিলাম। দিলাম উপহার হিসেবে একটি ওয়ালমেট। কিন্তু অনুষ্ঠানে ‘ইলা মিত্র স্মৃতি সংসদ’কে মঞ্চে তুলে ধরার কথা থাকলেও তা করা হয়নি। পত্রিকার নির্ধারিত বাজেটের ৮ হাজার টাকার মধ্যে ৮০ পয়সাও পাইনি। বরং কমিটির আহ্বায়ককে সভা আয়োজনের জন্য পত্রিকা বিক্রির টাকা দিয়েছিলাম। পরদিন ৭ নভেম্বর নবাবগঞ্জ সার্কিট হাউজে ইলা মিত্রের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলেন অজিত স্যার, নাদিম ও বাসার। কিন্তু দুঃখ আমার আমি যেতে পারিনি। সাক্ষাৎ করতেও পারিনি। তার ১ দিন পর পরীক্ষা থাকার কারণে। তাঁর সাথে আমার স্মৃতি বলতে নাচোল মঞ্চে তাঁর হাতে পত্রিকা এবং উপহার হিসেবে ওয়ালমেট তুলে দেয়া ওটুকুই। আমি বেঁচে থাকা পর্যন্ত এটুকু স্মৃতি সবসময় আমার কাছে জমা হয়ে থাকবে।
আজ ইলা মিত্রের মৃত্যু দিনে এ লেখায় অনেক কথাই বলে ফেললাম। বলা এজন্য যে, তাঁর নাচোল আসার পেছনে ইলা মিত্র স্মৃতি সংসদের হাসান স্যারদের নিয়ে করা অনুষ্ঠানটির বড় ভূমিকা ছিলো। কিন্তু সেটুকুর মূল্যায়ন করা হয়নি সংসদের প্রতি।
আজ ইলা মিত্রের মৃত্যু দিনে এ স্মৃতিগুলোই বার বার ভেসে উঠছিলো। হাসান আজিজুল হক স্যার এখনও নাচোল যান। ইলা মিত্রের মৃত্যুর পরের দিন তিনি এবং কয়েকজন গিয়ে শহীদ বেদীতে পুষ্পস্তবক দিয়ে আসেন। তাছাড়া এখন তাঁকে নিয়ে অনেকে উৎসাহী হয়ে কাজ করছেন। এখন দু’চারটা খবর পাই তাঁকে নিয়ে নাচোলে অনুষ্ঠান করার। অজিত স্যারের মুখে শুনেছি আমার ধারণাগুলো নিয়ে একটি এনজিও কাজ শুরু করতে যাচ্ছে। ভালোই তবে আমার সঙ্গে এখনও যোগাযোগ হয়নি। যাহোক, এটুকু তো বলা যায়, কাজ শুরু হলে কেউ না কেউ তা শেষ করবে।

আমরা আবার সবার মাঝে আসতে চাই।
উত্তরমুছুন