১৯ এপ্রিল, ২০০৫
দেশে গার্মেন্টসে অগ্নিকা-ের পাশাপাশি নতুন একটি দুর্ঘটনা যুক্ত হয়েছে। এ দুর্ঘটনার নাম ভবন ধস। এরকম একটি ঘটনা ঘটেছে গত ১০ এপ্রিল মধ্যরাতে সাভার বাইপাইলের পলাশবাড়িতে। স্পেকট্রাম নামে নয়তলা ভবনটি ধসে পড়ে একতলা ভবনে পরিণত হয় এবং দূর থেকে এটিকে দেখলে মনে হয় একটি টিলার মতন।
স্পেকট্রাম ভবন ধসে চাপা পড়ে প্রায় পাঁচশ শ্রমিক। আশঙ্কা করা হচ্ছে, চাপা পড়া শ্রমিকের মধ্যে তিনশ’রও মৃত্যু হতে পারে। যদিও এ লেখা পর্যন্ত ৭৭টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। জীবিত অবস্থায় বের করা হয়েছে ৯৬ জনকে। দুর্ঘটনার কয়েকদিন অতিবাহিত হলেও উদ্ধার কাজ এখনও শেষ হয়নি এবং আরও এক সপ্তাহ সময় লাগতে পারে বলে উদ্ধারকর্মীরা জানিয়েছে। যথারীতি দুর্ঘটনার কারণ নির্ণয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটি তদন্ত রিপোর্ট দেবে কিন্তু বাস্তবে এর কোন আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে কি-না সেটা সন্দেহের বিষয়।
মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনাটি ঘটেছিল ওই দিন রাত দেড়টার দিকে। এ সময় দু’টি গার্মেন্টস শাহরিয়ার ফেব্রিক্স এবং স্পেকট্রাম সুয়েটারস লিমিটেডের নাইট শিফট চলছিল। মোট নয়তলা ভবনের সপ্তম, চতুর্থ, তৃতীয় ও নিচতলায় গার্মেন্টস শ্রমিকরা কর্মরত ছিল। বাকি সব তলা ছিল বন্ধ। জানা যায়, ওই দিন চা-বিরতির পর পুনরায় কাজ শুরুর সময় কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগে ভবনটি ডানদিক থেকে বামে মোচড় দিয়ে ওঠে এবং ছাদ ভেঙে নিচে নেমে আসতে শুরু করে। তারপর শুরু হয়ে যায় আটকপেড়া নারী-পুরুষদের গগনবিদারী আর্তচিৎকার ‘বাঁচাও’ ‘বাঁচাও’। তাদের চিৎকারে পলাশবাড়ির আকাশ-বাতাস ভারিই হয়েছে শুধু। জীবিত বের হয়ে আসতে পারেনি অনেকেই।
ঘটনার একদিন পর অর্থাৎ ১২ এপ্রিল পত্রিকায় শাহরিয়ার ফেব্রিক্স এবং স্পেকট্রাম সুয়েটারস লি. কর্তৃপক্ষ কালার বিজ্ঞাপন দিয়ে শ্রমিকদের মৃত্যুতে গভীর শোকবার্তা ও সহানুভূতি জ্ঞাপন করে। বিজ্ঞাপনে এ দুর্ঘটনা বয়লার বিস্ফোরণজনিত বলে উল্লেখ করা হয়। বিজ্ঞাপনে শোক ও সহানুভূতি প্রকাশের চেয়ে মালিকপক্ষ নিজেদের ক্ষতির কথাই বোঝাতে চেয়েছেন। পাশাপাশি অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন বিজিএমইএ’র প্রচলিত নীতিমালা অনুযায়ী আর্থিক ক্ষতিপূরণসহ প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সহকারী জেনারেল ম্যানেজার মহিউদ্দিন আহম্মেদের নামে দেয়া এ বিজ্ঞাপনে তারিখ ছিল ১১ এপ্রিল।
দ্বিতীয় আরেকটি বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয় পরদিন ১৩ এপ্রিল। এ বিজ্ঞাপনে আগের বিজ্ঞাপনের বক্তব্যের সাথে ভবন নির্মাণের বর্ণনা দেয়া হয়। লক্ষণীয় হলো, ভবন নির্মাণের বর্ণনা দেয়া হয়। লক্ষণীয় হলো, ভবন নির্মাণে কি পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে এবং কি রড কিংবা কি সিমেন্ট ব্যবহার করা হয়েছে তার নাম দেয়া হলেও যে প্রকৌশলীর তত্ত্বাবধানে ভবনটি নির্মিত হয়েছে তার নাম দেয়া হয়নি। বিজ্ঞাপনে যথারীতি নিজেদের ব্যবসার স্তুতি গেয়েছেন। তবে এ বিজ্ঞাপনে স্পেকট্রাম ভবন ধসে পড়াকে অনাকাক্সিক্ষত বলা হলেও আগের বিজ্ঞাপনের মতো বলা হয়নি বয়লার বিস্ফোরণজনিত কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
না বলতে পারার কারণ দেখতে পাওয়া যায় ভবনের ধ্বংস্তূপ থেকে বেঁচে যাওয়া স্পেকট্রাম গার্মেন্টসের বয়লারের সহকারী অপারেটর পলাশের ভাষ্য থেকে। পলাশের ভাষ্য, ভবনের বয়লার বিস্ফোরণ হয়নি। কারণ, তিনি বয়লারের একদম কাছেই ছিলেন। বয়লার বিস্ফোরণ হলে তার বেঁচে থাকার কথা নয়। তাছাড়া বয়লারের গরম পানিও ছড়িয়ে পড়ার কথা। কিন্তু কোথাও গরম তো দূরের কথা কোন পানির স্পর্শই তিনি পাননি। পলাশের এ বক্তব্য থেকে মালিকপক্ষের বয়লার বিস্ফোরণজনিত কারণটি খারিজ হয়ে যায়। বোধকরি মালিকপক্ষ পলাশের এ বক্তব্যের কারণে পরের বিজ্ঞাপনে বয়লার বিস্ফোরণজনিত কারণকে উল্লেখ করার সাহস পাননি।
এ তো গেল মালিকপক্ষের বিবরণ। বিবরণ দিয়েছে পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি আনিসুল হক। তিনি একটি দৈনিক পত্রিকাকে জানিয়েছেন, সংগঠনের বিধান অনুযায়ী গার্মেন্টসে দুর্ঘটনার কারণে কোন গার্মেন্টস মালিকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার এখতিয়ার নেই। এটি সরকারের বিচার বিভাগের কাজ। বিজিএমইএ কোন অনিয়ম পেলে বা অসদাচরণ করলে সদস্যদের সদস্য পদ বাতিল করতে পারে শুধু।
এদিকে সরকারের গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী মির্জা আব্বাস বিবিসির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, কোনরকম অনুমতি না নিয়েই স্পেকট্রাম ভবন নির্মাণ করা হয়েছিল। অবৈধভাবে নির্মিত এমন অনেক ভবন সরকার চিহ্নিত করলেও সেগুলো ভেঙে ফেলা সম্ভব হচ্ছে না ভবন মালিকরা আদালতে আশ্রয় নেয়ার কারণে বলে মন্ত্রী উল্লেখ করেন। ভবনটি নির্মাণে সঠিক নকাশ অনুসরণ এবং রাজউকের অনুমোদন নেয়া হয়নি বলেও তিনি জানান। এতবড় ভবন সবার অগোচরে নির্মাণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যাদের ভবন তৈরি করা দরকার তারা রাজউককে আড়ালে রেখেই তৈরি করে নিতে চায়। তাছাড়া ভবন মালিকের সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের সংশ্লিষ্টতা প্রসঙ্গে মির্জা আব্বাস বলেন, ক্ষমতাসীন দলের কে আছে তা আমার জানার বিষয় নয়। এখন রাজউক থেকে যে ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার তা আমরা নেব।
এ বিষয়ক বক্তব্য আরও আছে। সেটি সাভার ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের। বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা একটি দৈনিক পত্রিকাকে জানিয়েছেন, ‘সাভার ক্যান্টনমেন্ট সংশ্লিষ্ট এলাকায় ভবন নির্মাণ করতে হলে বোর্ডের অনুমোদন লাগে। কিন্তু স্পেকট্রাম ভবন নির্মাণের জন্য কোন অনুমোদন নেয়া হয়নি। তবে স্পেকট্রাম মালিক ২০০২ সালে নির্ধারিত ফি দিয়ে একটি চারতলা ভবন নির্মাণের জন্য বোর্ডের কাছে আবেদন করেছিলেন এবং ২০০৪ সালে তিনি চারতলা ভবনের একটি নকশা জমা দেন। নিয়ম অনুযায়ী নকশা অনুমোদিত হলে মালিকের নিজে এসে তা নিয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু স্পেকট্রাম মালিকপক্ষ সেটাও নিয়ে যায়নি।’ বোর্ড প্রধান আরও জানান, ‘স্পেকট্রাম মালিকপক্ষ চারতলার যে নকশাটি জমা দিয়েছিলেন সেটা আসলে সামনের ভবনের। পেছনের নয়তলা ভবনের কোন নকশা জমা দেয়া দূরে থাক, নীতিগত অনুমোদন নেয়নি মালিকপক্ষ।’ প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ধসে পড়া স্পেকট্রাম ভবনের সামনে স্পেকট্রামের আরেকটি চারতলা ভবন রয়েছে, যেটি ১২ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
বোর্ডের প্রকৌশলী জানিয়েছেন, ‘গত দেড় বছরে ভবন নির্মাণের জন্য সাড়ে তিনশ’র মতো আবেদন পড়েছে, যার মধ্যে পনের শতাংশই বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের। তবে এর বাইরেও অনেকে অনুমোদন না নিয়ে ভবন নির্মাণ করেছে।’
উপরোক্ত সব বিবরণ এবং পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টে একটা বিষয় স্পষ্ট, ত্রুটিপূর্ণ ভবন নির্মাণের জন্যই এ ধস। এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। অথচ বাণিজ্যমন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরী স্পেকট্রাম ভবন মালিকের গুণগান গেয়ে বলেছেন, ‘এটি একটি নিছক দুর্ঘটনা। শাহরিয়ার হোসেন একজন স্বনামধন্য ব্যবসায়ী। দেশ-বিদেশে তার ব্যবসায়িক সুনাম রয়েছে।’ যেখানে সরকারের এক মন্ত্রী মির্জা আব্বাস বলছেন, উন্নত সামগ্রী ব্যবহার না করার কারণেই ভবন ধসেছে’, সেখানে আরেক মন্ত্রী আলতাফ হোসেন বলছেন, ‘এটি একটি নিছক দুর্ঘটনা।’ জানি না, আলতাফ হোসেনকে এ কথা বলার জন্য স্পেকট্রাম কর্তৃপক্ষ কিভাবে ম্যানেজ করেছেন!
স্পেকট্রাম ভবন ধসে গার্মেন্টস শ্রমিকের মৃত্যু এবং আটকেপড়া শ্রমিকদের উদ্দেশে রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী শোক এবং সহানুভূতি জ্ঞাপন করেছেন। বিরোধীদলীয় নেত্রী এবং অন্যান্য সংগঠনের পক্ষ থেকেও শোক এবং সহানুভূতি প্রকাশ করা হয়েছে। পাশাপাশি ক্ষতিপূরণসহ এ ঘটনার দ্রুত বিচার দাবি করেছেন। এসব পুরনো পদ্ধতি, পুরনো কাসুন্দি। কেননা উপরোক্ত বক্তব্যগুলো তুলে ধরার উদ্দেশ্য এ কারণেই যে, বিগত দিনের দুর্ঘটনাগুলোর পরও এসব বক্তব্যই দেখা গেছে। লক্ষ্য করার বিষয় হলো, দুর্ঘটনার পর বিভিন্ন সংগঠন থেকে যে দাবিটি সর্বাগ্রে ওঠে তা হলো ক্ষতিপূরণ আদায়ের। ক্ষতিপূরণ পেলেই যেন দুর্ঘটনা হালালে পরিণত হবে। গার্মেন্টস শিল্পে অগ্নিকা-ের কারণ সম্পর্কে সবাই অবগত। এও অবগত অগ্নিকা-ে কিভাবে গার্মেন্টস শ্রমিকের মৃত্যু ঘটে। কারণগুলো সবার জানা হলেও এগুলো প্রতিকারের দাবিটা খুব একটা চোখে পড়ার মতো নয়। আর দেশের রাষ্ট্রযন্ত্রের মাথাভারী প্রশাসন দুর্ঘটনার পর একই বক্তব্য হাজির করেনÑ ‘এ কারণে হয়েছে, ও কারণে হয়েছে, নিয়ম মানা হয়নি, ওটা করা হয়নি, তালিকা হয়েছে, ব্যবস্থা নেয়া হবে’ ইত্যাদি ইত্যাদি কথাবার্তা।
ভাবখানা এমন, তাদের চাকরি বোধহয় দুর্ঘটনা ঘটার পর বিবৃতি দেয়ার জন্যই। তারপর তদন্ত কমিটি গঠন, কয়েকদিন এ নিয়ে চোটপাট। ব্যাস! ওই পর্যন্তই। আবারও নতুন দুর্ঘটনা, আবারও একই বিষয়। এভাবেই চলছে বলেই বিগত পনের বছরে গার্মেন্টসে বিভিন্ন দুর্ঘটনায় প্রায় তিনশ’ অসহায় শ্রমিকের মৃত্যু ঘটেছে। এর একটি ঘটনার জন্য গার্মেন্টস মালিকের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানা যায় না। আসলে পুঁজির দাপটের কাছে সাধারণ মানুষ অর্থাৎ খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষের মৃত্যু খুবই তুচ্ছ। এ দেশে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে যাদের অবদান সবচাইতে বেশি সে গার্মেন্টস শ্রমিকের মর্যাদা বা মৃত্যুর মূল্য হয়তো পঞ্চাশ হাজার বা লাখখানেক টাকা! এর বেশি নয়। জাতীয় অর্থনীতিতে এরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও তারা জাতীয়ভাবেই অবহেলা এবং বঞ্চনার শিকার। যার দরুণ যুগ যুগ ধরে শ্রমজীবী মানুষ অবহেলিত এবং নির্যাতিত। এদের নিরাপত্তার প্রয়োজন নেই, এদের জীবনের মূল্যও নেই। অথচ গার্মেন্টস মালিকরা বেশ উচ্চস্বরেই নিজেদের ব্যবসার গুণকীর্তন করে বেড়ান। অত্যাধিক মুনাফা আয়ের জন্য শ্রমিকদের ওপর যে কদর্য আচরণ তারা করে থাকেন তা চাপাই থেকে যায়।
এই যে স্পেকট্রাম ভবন ধসে পড়লো কিন্তু মালিকপক্ষের টিকিটিও খুঁজে পেল না কেউ ঘটনার পর। কিন্তু কেন? সেটা কি মালিকপক্ষকে টিকিয়ে রাখার জন্য? বোর্ড এবং রাজউক যে এখন বলছে, অনুমোদন না নিয়ে এ ত্রুটিপূর্ণ ভবন নির্মাণ হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, ভবন তো একদিকে নির্মিত হয়নি। তাহলে এ সময়ে কি তারা নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছিলেন, দুর্ঘটনা ঘটুক তারপর দেখা যাবে এ ভেবে নিয়ে! তারা যদি এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নাই নিতে পারেন তবে জনগণের গাঁটের পয়সা খরচ করে এসব অকর্মণ্য প্রশাসনকে পোষবার কোন যৌক্তিকতা আছে কিনা তা ভেবে দেখার বিষয়।
এ দেশের জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। তারা পেটের কাছে দায়বদ্ধ। দায়বদ্ধ বলেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিশ্চিত বিপদ জেনেও কাজ করে যেতে বাধ্য হয় তারা। দেশের সর্বত্র বোমা বা গ্রেনেড হামলা বাড়লেও জীবনযাত্রা থমকে যায়নি। যায়নি, দায়বদ্ধতার কারণে। অথচ এদের দেখভাল করার জন্য যাদেরকে নিয়োজিত করা হয় তারাই এ সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছেন। স্পেকট্রাম ভবন ধসে যারা নিহত হয়েছেন তারা হয়তো একটা ক্ষতিপূরণ পাবেন। সেটার পরিমাণ হয়তো পঞ্চাশ হাজার কিংবা লাখ টাকার মতো। কারণ এ শ্রেণীর মানুষের মৃত্যুর মানদ- করা হয় টাকার অংকে। বছরের পর বছর শ্রম দিয়ে রাষ্ট্রের কোষাগার এবং মালিকপক্ষের পকেট ভরলেও তাদের মূল্য ওই ক’টা টাকাই। যার শ্রমে মালিকের গাড়ি-বাড়ি হয়, তার তিনবেলা খাবার জোটাতেই ঘাম ঝরাতে হয় প্রতিনিয়ত। তবে যে কথা না বললেই নয় তা হলো, নিহতরা ক্ষতিপূরণ পেলেও যাদের জীবিত কিংবা পঙ্গু হয়ে জীবনযাপন করতে হবে তাদের ক্ষতি কি টাকা দিয়ে পূরণ করার মতো? কিংবা যারা ওই ভবনের গার্মেন্টসে চাকরি করছিল ভবন ধসে পড়ার সাথে সাথে তাদের চাকরিটাও গেল। এদের কর্মসংস্থানেরই বা কি হবে- এ প্রশ্নের উত্তরটাও জরুরি। সর্বাগ্রে জরুরি এসব অনিয়ম, অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদের। ক্ষতিপূরণ নয়, লড়াইটা হওয়া উচিত নিরাপদ কাজ করার পরিবেশের দাবিতে। আর এ দাবি যতদিন পূরণ না হবে ততদিন দেখে যেতে হবে একের পর এক দুর্ঘটনা। যেখানে বলি হবে খেটে খাওয়া এসব শ্রমজীবীরা।
আর এসব ঘটনায় দেশের রাষ্ট্রযন্ত্র কিংবা প্রশাসনের বোধোদয় কবে ঘটবে তা স্পষ্ট করে বলা সম্ভব নয়। তবে লড়াইটা যেদিন সার্থক হবে সেদিন হয়তো তাদের বোধোদয় ঘটলেও ঘটতে পারে।
স্পেকট্রাম ভবন ধসে চাপা পড়ে প্রায় পাঁচশ শ্রমিক। আশঙ্কা করা হচ্ছে, চাপা পড়া শ্রমিকের মধ্যে তিনশ’রও মৃত্যু হতে পারে। যদিও এ লেখা পর্যন্ত ৭৭টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। জীবিত অবস্থায় বের করা হয়েছে ৯৬ জনকে। দুর্ঘটনার কয়েকদিন অতিবাহিত হলেও উদ্ধার কাজ এখনও শেষ হয়নি এবং আরও এক সপ্তাহ সময় লাগতে পারে বলে উদ্ধারকর্মীরা জানিয়েছে। যথারীতি দুর্ঘটনার কারণ নির্ণয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটি তদন্ত রিপোর্ট দেবে কিন্তু বাস্তবে এর কোন আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে কি-না সেটা সন্দেহের বিষয়।
মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনাটি ঘটেছিল ওই দিন রাত দেড়টার দিকে। এ সময় দু’টি গার্মেন্টস শাহরিয়ার ফেব্রিক্স এবং স্পেকট্রাম সুয়েটারস লিমিটেডের নাইট শিফট চলছিল। মোট নয়তলা ভবনের সপ্তম, চতুর্থ, তৃতীয় ও নিচতলায় গার্মেন্টস শ্রমিকরা কর্মরত ছিল। বাকি সব তলা ছিল বন্ধ। জানা যায়, ওই দিন চা-বিরতির পর পুনরায় কাজ শুরুর সময় কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগে ভবনটি ডানদিক থেকে বামে মোচড় দিয়ে ওঠে এবং ছাদ ভেঙে নিচে নেমে আসতে শুরু করে। তারপর শুরু হয়ে যায় আটকপেড়া নারী-পুরুষদের গগনবিদারী আর্তচিৎকার ‘বাঁচাও’ ‘বাঁচাও’। তাদের চিৎকারে পলাশবাড়ির আকাশ-বাতাস ভারিই হয়েছে শুধু। জীবিত বের হয়ে আসতে পারেনি অনেকেই।
ঘটনার একদিন পর অর্থাৎ ১২ এপ্রিল পত্রিকায় শাহরিয়ার ফেব্রিক্স এবং স্পেকট্রাম সুয়েটারস লি. কর্তৃপক্ষ কালার বিজ্ঞাপন দিয়ে শ্রমিকদের মৃত্যুতে গভীর শোকবার্তা ও সহানুভূতি জ্ঞাপন করে। বিজ্ঞাপনে এ দুর্ঘটনা বয়লার বিস্ফোরণজনিত বলে উল্লেখ করা হয়। বিজ্ঞাপনে শোক ও সহানুভূতি প্রকাশের চেয়ে মালিকপক্ষ নিজেদের ক্ষতির কথাই বোঝাতে চেয়েছেন। পাশাপাশি অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন বিজিএমইএ’র প্রচলিত নীতিমালা অনুযায়ী আর্থিক ক্ষতিপূরণসহ প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সহকারী জেনারেল ম্যানেজার মহিউদ্দিন আহম্মেদের নামে দেয়া এ বিজ্ঞাপনে তারিখ ছিল ১১ এপ্রিল।
দ্বিতীয় আরেকটি বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয় পরদিন ১৩ এপ্রিল। এ বিজ্ঞাপনে আগের বিজ্ঞাপনের বক্তব্যের সাথে ভবন নির্মাণের বর্ণনা দেয়া হয়। লক্ষণীয় হলো, ভবন নির্মাণের বর্ণনা দেয়া হয়। লক্ষণীয় হলো, ভবন নির্মাণে কি পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে এবং কি রড কিংবা কি সিমেন্ট ব্যবহার করা হয়েছে তার নাম দেয়া হলেও যে প্রকৌশলীর তত্ত্বাবধানে ভবনটি নির্মিত হয়েছে তার নাম দেয়া হয়নি। বিজ্ঞাপনে যথারীতি নিজেদের ব্যবসার স্তুতি গেয়েছেন। তবে এ বিজ্ঞাপনে স্পেকট্রাম ভবন ধসে পড়াকে অনাকাক্সিক্ষত বলা হলেও আগের বিজ্ঞাপনের মতো বলা হয়নি বয়লার বিস্ফোরণজনিত কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
না বলতে পারার কারণ দেখতে পাওয়া যায় ভবনের ধ্বংস্তূপ থেকে বেঁচে যাওয়া স্পেকট্রাম গার্মেন্টসের বয়লারের সহকারী অপারেটর পলাশের ভাষ্য থেকে। পলাশের ভাষ্য, ভবনের বয়লার বিস্ফোরণ হয়নি। কারণ, তিনি বয়লারের একদম কাছেই ছিলেন। বয়লার বিস্ফোরণ হলে তার বেঁচে থাকার কথা নয়। তাছাড়া বয়লারের গরম পানিও ছড়িয়ে পড়ার কথা। কিন্তু কোথাও গরম তো দূরের কথা কোন পানির স্পর্শই তিনি পাননি। পলাশের এ বক্তব্য থেকে মালিকপক্ষের বয়লার বিস্ফোরণজনিত কারণটি খারিজ হয়ে যায়। বোধকরি মালিকপক্ষ পলাশের এ বক্তব্যের কারণে পরের বিজ্ঞাপনে বয়লার বিস্ফোরণজনিত কারণকে উল্লেখ করার সাহস পাননি।
এ তো গেল মালিকপক্ষের বিবরণ। বিবরণ দিয়েছে পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি আনিসুল হক। তিনি একটি দৈনিক পত্রিকাকে জানিয়েছেন, সংগঠনের বিধান অনুযায়ী গার্মেন্টসে দুর্ঘটনার কারণে কোন গার্মেন্টস মালিকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার এখতিয়ার নেই। এটি সরকারের বিচার বিভাগের কাজ। বিজিএমইএ কোন অনিয়ম পেলে বা অসদাচরণ করলে সদস্যদের সদস্য পদ বাতিল করতে পারে শুধু।
এদিকে সরকারের গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী মির্জা আব্বাস বিবিসির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, কোনরকম অনুমতি না নিয়েই স্পেকট্রাম ভবন নির্মাণ করা হয়েছিল। অবৈধভাবে নির্মিত এমন অনেক ভবন সরকার চিহ্নিত করলেও সেগুলো ভেঙে ফেলা সম্ভব হচ্ছে না ভবন মালিকরা আদালতে আশ্রয় নেয়ার কারণে বলে মন্ত্রী উল্লেখ করেন। ভবনটি নির্মাণে সঠিক নকাশ অনুসরণ এবং রাজউকের অনুমোদন নেয়া হয়নি বলেও তিনি জানান। এতবড় ভবন সবার অগোচরে নির্মাণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যাদের ভবন তৈরি করা দরকার তারা রাজউককে আড়ালে রেখেই তৈরি করে নিতে চায়। তাছাড়া ভবন মালিকের সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের সংশ্লিষ্টতা প্রসঙ্গে মির্জা আব্বাস বলেন, ক্ষমতাসীন দলের কে আছে তা আমার জানার বিষয় নয়। এখন রাজউক থেকে যে ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার তা আমরা নেব।
এ বিষয়ক বক্তব্য আরও আছে। সেটি সাভার ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের। বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা একটি দৈনিক পত্রিকাকে জানিয়েছেন, ‘সাভার ক্যান্টনমেন্ট সংশ্লিষ্ট এলাকায় ভবন নির্মাণ করতে হলে বোর্ডের অনুমোদন লাগে। কিন্তু স্পেকট্রাম ভবন নির্মাণের জন্য কোন অনুমোদন নেয়া হয়নি। তবে স্পেকট্রাম মালিক ২০০২ সালে নির্ধারিত ফি দিয়ে একটি চারতলা ভবন নির্মাণের জন্য বোর্ডের কাছে আবেদন করেছিলেন এবং ২০০৪ সালে তিনি চারতলা ভবনের একটি নকশা জমা দেন। নিয়ম অনুযায়ী নকশা অনুমোদিত হলে মালিকের নিজে এসে তা নিয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু স্পেকট্রাম মালিকপক্ষ সেটাও নিয়ে যায়নি।’ বোর্ড প্রধান আরও জানান, ‘স্পেকট্রাম মালিকপক্ষ চারতলার যে নকশাটি জমা দিয়েছিলেন সেটা আসলে সামনের ভবনের। পেছনের নয়তলা ভবনের কোন নকশা জমা দেয়া দূরে থাক, নীতিগত অনুমোদন নেয়নি মালিকপক্ষ।’ প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ধসে পড়া স্পেকট্রাম ভবনের সামনে স্পেকট্রামের আরেকটি চারতলা ভবন রয়েছে, যেটি ১২ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
বোর্ডের প্রকৌশলী জানিয়েছেন, ‘গত দেড় বছরে ভবন নির্মাণের জন্য সাড়ে তিনশ’র মতো আবেদন পড়েছে, যার মধ্যে পনের শতাংশই বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের। তবে এর বাইরেও অনেকে অনুমোদন না নিয়ে ভবন নির্মাণ করেছে।’
উপরোক্ত সব বিবরণ এবং পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টে একটা বিষয় স্পষ্ট, ত্রুটিপূর্ণ ভবন নির্মাণের জন্যই এ ধস। এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। অথচ বাণিজ্যমন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরী স্পেকট্রাম ভবন মালিকের গুণগান গেয়ে বলেছেন, ‘এটি একটি নিছক দুর্ঘটনা। শাহরিয়ার হোসেন একজন স্বনামধন্য ব্যবসায়ী। দেশ-বিদেশে তার ব্যবসায়িক সুনাম রয়েছে।’ যেখানে সরকারের এক মন্ত্রী মির্জা আব্বাস বলছেন, উন্নত সামগ্রী ব্যবহার না করার কারণেই ভবন ধসেছে’, সেখানে আরেক মন্ত্রী আলতাফ হোসেন বলছেন, ‘এটি একটি নিছক দুর্ঘটনা।’ জানি না, আলতাফ হোসেনকে এ কথা বলার জন্য স্পেকট্রাম কর্তৃপক্ষ কিভাবে ম্যানেজ করেছেন!
স্পেকট্রাম ভবন ধসে গার্মেন্টস শ্রমিকের মৃত্যু এবং আটকেপড়া শ্রমিকদের উদ্দেশে রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী শোক এবং সহানুভূতি জ্ঞাপন করেছেন। বিরোধীদলীয় নেত্রী এবং অন্যান্য সংগঠনের পক্ষ থেকেও শোক এবং সহানুভূতি প্রকাশ করা হয়েছে। পাশাপাশি ক্ষতিপূরণসহ এ ঘটনার দ্রুত বিচার দাবি করেছেন। এসব পুরনো পদ্ধতি, পুরনো কাসুন্দি। কেননা উপরোক্ত বক্তব্যগুলো তুলে ধরার উদ্দেশ্য এ কারণেই যে, বিগত দিনের দুর্ঘটনাগুলোর পরও এসব বক্তব্যই দেখা গেছে। লক্ষ্য করার বিষয় হলো, দুর্ঘটনার পর বিভিন্ন সংগঠন থেকে যে দাবিটি সর্বাগ্রে ওঠে তা হলো ক্ষতিপূরণ আদায়ের। ক্ষতিপূরণ পেলেই যেন দুর্ঘটনা হালালে পরিণত হবে। গার্মেন্টস শিল্পে অগ্নিকা-ের কারণ সম্পর্কে সবাই অবগত। এও অবগত অগ্নিকা-ে কিভাবে গার্মেন্টস শ্রমিকের মৃত্যু ঘটে। কারণগুলো সবার জানা হলেও এগুলো প্রতিকারের দাবিটা খুব একটা চোখে পড়ার মতো নয়। আর দেশের রাষ্ট্রযন্ত্রের মাথাভারী প্রশাসন দুর্ঘটনার পর একই বক্তব্য হাজির করেনÑ ‘এ কারণে হয়েছে, ও কারণে হয়েছে, নিয়ম মানা হয়নি, ওটা করা হয়নি, তালিকা হয়েছে, ব্যবস্থা নেয়া হবে’ ইত্যাদি ইত্যাদি কথাবার্তা।
ভাবখানা এমন, তাদের চাকরি বোধহয় দুর্ঘটনা ঘটার পর বিবৃতি দেয়ার জন্যই। তারপর তদন্ত কমিটি গঠন, কয়েকদিন এ নিয়ে চোটপাট। ব্যাস! ওই পর্যন্তই। আবারও নতুন দুর্ঘটনা, আবারও একই বিষয়। এভাবেই চলছে বলেই বিগত পনের বছরে গার্মেন্টসে বিভিন্ন দুর্ঘটনায় প্রায় তিনশ’ অসহায় শ্রমিকের মৃত্যু ঘটেছে। এর একটি ঘটনার জন্য গার্মেন্টস মালিকের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানা যায় না। আসলে পুঁজির দাপটের কাছে সাধারণ মানুষ অর্থাৎ খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষের মৃত্যু খুবই তুচ্ছ। এ দেশে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে যাদের অবদান সবচাইতে বেশি সে গার্মেন্টস শ্রমিকের মর্যাদা বা মৃত্যুর মূল্য হয়তো পঞ্চাশ হাজার বা লাখখানেক টাকা! এর বেশি নয়। জাতীয় অর্থনীতিতে এরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও তারা জাতীয়ভাবেই অবহেলা এবং বঞ্চনার শিকার। যার দরুণ যুগ যুগ ধরে শ্রমজীবী মানুষ অবহেলিত এবং নির্যাতিত। এদের নিরাপত্তার প্রয়োজন নেই, এদের জীবনের মূল্যও নেই। অথচ গার্মেন্টস মালিকরা বেশ উচ্চস্বরেই নিজেদের ব্যবসার গুণকীর্তন করে বেড়ান। অত্যাধিক মুনাফা আয়ের জন্য শ্রমিকদের ওপর যে কদর্য আচরণ তারা করে থাকেন তা চাপাই থেকে যায়।
এই যে স্পেকট্রাম ভবন ধসে পড়লো কিন্তু মালিকপক্ষের টিকিটিও খুঁজে পেল না কেউ ঘটনার পর। কিন্তু কেন? সেটা কি মালিকপক্ষকে টিকিয়ে রাখার জন্য? বোর্ড এবং রাজউক যে এখন বলছে, অনুমোদন না নিয়ে এ ত্রুটিপূর্ণ ভবন নির্মাণ হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, ভবন তো একদিকে নির্মিত হয়নি। তাহলে এ সময়ে কি তারা নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছিলেন, দুর্ঘটনা ঘটুক তারপর দেখা যাবে এ ভেবে নিয়ে! তারা যদি এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নাই নিতে পারেন তবে জনগণের গাঁটের পয়সা খরচ করে এসব অকর্মণ্য প্রশাসনকে পোষবার কোন যৌক্তিকতা আছে কিনা তা ভেবে দেখার বিষয়।
এ দেশের জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। তারা পেটের কাছে দায়বদ্ধ। দায়বদ্ধ বলেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিশ্চিত বিপদ জেনেও কাজ করে যেতে বাধ্য হয় তারা। দেশের সর্বত্র বোমা বা গ্রেনেড হামলা বাড়লেও জীবনযাত্রা থমকে যায়নি। যায়নি, দায়বদ্ধতার কারণে। অথচ এদের দেখভাল করার জন্য যাদেরকে নিয়োজিত করা হয় তারাই এ সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছেন। স্পেকট্রাম ভবন ধসে যারা নিহত হয়েছেন তারা হয়তো একটা ক্ষতিপূরণ পাবেন। সেটার পরিমাণ হয়তো পঞ্চাশ হাজার কিংবা লাখ টাকার মতো। কারণ এ শ্রেণীর মানুষের মৃত্যুর মানদ- করা হয় টাকার অংকে। বছরের পর বছর শ্রম দিয়ে রাষ্ট্রের কোষাগার এবং মালিকপক্ষের পকেট ভরলেও তাদের মূল্য ওই ক’টা টাকাই। যার শ্রমে মালিকের গাড়ি-বাড়ি হয়, তার তিনবেলা খাবার জোটাতেই ঘাম ঝরাতে হয় প্রতিনিয়ত। তবে যে কথা না বললেই নয় তা হলো, নিহতরা ক্ষতিপূরণ পেলেও যাদের জীবিত কিংবা পঙ্গু হয়ে জীবনযাপন করতে হবে তাদের ক্ষতি কি টাকা দিয়ে পূরণ করার মতো? কিংবা যারা ওই ভবনের গার্মেন্টসে চাকরি করছিল ভবন ধসে পড়ার সাথে সাথে তাদের চাকরিটাও গেল। এদের কর্মসংস্থানেরই বা কি হবে- এ প্রশ্নের উত্তরটাও জরুরি। সর্বাগ্রে জরুরি এসব অনিয়ম, অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদের। ক্ষতিপূরণ নয়, লড়াইটা হওয়া উচিত নিরাপদ কাজ করার পরিবেশের দাবিতে। আর এ দাবি যতদিন পূরণ না হবে ততদিন দেখে যেতে হবে একের পর এক দুর্ঘটনা। যেখানে বলি হবে খেটে খাওয়া এসব শ্রমজীবীরা।
আর এসব ঘটনায় দেশের রাষ্ট্রযন্ত্র কিংবা প্রশাসনের বোধোদয় কবে ঘটবে তা স্পষ্ট করে বলা সম্ভব নয়। তবে লড়াইটা যেদিন সার্থক হবে সেদিন হয়তো তাদের বোধোদয় ঘটলেও ঘটতে পারে।

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন