শুরুতেই দৈনিক মানবজমিন পত্রিকার প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান
চৌধুরীর একটি নিবন্ধের অংশবিশেষ তুলে ধরছি। ‘হাসিনার ‘অডিও বিপ্লব’ এবং অন্তর্বর্তী সরকার’ শিরোনামে ৭ অক্টোবর প্রকাশিত নিবন্ধে তিনি বলেছেন, “...শেখ হাসিনা যাই বলেন না কেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এখনও নড়বড়ে, দুর্বল। দিক নির্দেশনাহীন। পেছনে সেনা সমর্থন না থাকলে তাদের অবস্থা কেমন হবে? সরকারের ভেতরে রাজনৈতিক শক্তির উপস্থিতি না থাকায় এমনটা হয়েছে। যদিও রাজনৈতিক দলগুলো নিজ নিজ অবস্থান থেকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। দু’মাস কেটে গেলো এভাবেই। সংলাপে যোগ দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে। বিএনপি চাচ্ছে যৌক্তিক সংস্কার শেষে দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্বাচন। জামায়াত হাঁটছে ভিন্ন স্রোতে। তারা চায় সংস্কার শেষে নির্বাচন। এটা কিন্তু বলা হচ্ছে না সংস্কারের জন্য কতোদিন সময় দরকার। জামায়াত হয়তো জানে না এই কৌশল পরাজিত শক্তিকেই উৎসাহিত করবে। তারা অবশ্য বারবার ভুল পথেই পা বাড়ায়।...”এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করে বলতেই হয় যে, অন্তর্বর্তী সরকার এখনো দুর্বল অবস্থাতেই আছে। কেননা কোনো গণঅভ্যুত্থান বা গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে সরকার গঠন হয় এবং তার যে গতি থাকা দরকার, সেটা অনেকাংশেই অনুপস্থিত।
শুধু প্রশাসনে রদবদলের মধ্যে থাকলেই হবে না। একটা বিষয়ের উল্লেখ করা হচ্ছে। তা হলো, ফেসবুকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামকে নিয়ে কটূক্তির অভিযোগে গত ২৪ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামে মোকতার হোসেন নামে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে সাইবার ট্রাইব্যুনাল আইনে মামলা হয়েছে। বিশদে না গিয়ে শুধু বলা যায়, এটাকেও ভালো চোখে দেখার সুযোগ নেই। এই নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের জোরালো ভূমিকা প্রয়োজন।
অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নেয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত যেটা জোরের সঙ্গে বলা হচ্ছে, তা হলো সংস্কার। কী কী সংস্কার করা হবে, তা অবশ্য বলা হয়েছে। এবং এরই মধ্যে সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, পুলিশ ও দুর্নীতি দমন বিষয়ে সংস্কারের জন্য ছয়টি কমিশন গঠন করা হয়েছে। অবশ্য সংবিধান বাদে ৫টি সংস্কার কমিশন গঠনের প্রজ্ঞাপন গত ৪ অক্টোবর জারি করা হয়। আর ৭ অক্টোবর জারি করা হয় সংবিধান সংস্কার কমিটি গঠনের প্রজ্ঞাপন।
উল্লেখ থাকে যে, সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে প্রথমে আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিকের নাম ঘোষণা করা হলেও পরে পরিবর্তন করে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির ডিস্টিংগুইশড অধ্যাপক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. আলী রীয়াজের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
অন্তর্বর্তী সরকার কতদিন থাকবে-- এ নিয়ে পরিষ্কার কোনো ধারণা পাওয়া যায়নি। তবে ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা মাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাৎকারে এ বিষয়ক প্রশ্নের উত্তরে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, “... সরকার কখন মেয়াদ ঠিক করবে সেটা সরকারকে বলতে হবে। সরকার না বলা পর্যন্ত সেটা তো সরকারের মেয়াদ হচ্ছে না। ... আমাদেরই বলতে হবে। আমাদেরকেই বলতে হবে। আমাদের মুখ থেকে যখন শুনবেন তখন সেটাই হবে তারিখ।” সাক্ষাৎকারটি ভয়েস অব আমেরিকার ওয়েবসাইটে ১ অক্টোবর প্রকাশিত হয়।
প্রধান উপদেষ্টার এই কথা থেকে স্পষ্ট, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ তাদের মুখ থেকে শোনার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। যদিওবা এর আগে বলা হচ্ছিল, দেশের জনগণ তাদেরকে (অন্তর্বর্তী সরকার) যতদিন চাইবেন, ততদিন তারা থাকবেন।
কিন্তু প্রশ্ন হলো অপেক্ষাটা কতদিনের? তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেয়া যায়, দুই বছর থাকবেন; তাহলে বলতে হয় দুই বছরের মধ্যে দুই মাস সময়টাও নেহায়েত কম নয়। এখন প্রতিটি সময়কেই কাজে লাগাতে হবে।
তাছাড়া রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কার করতে কতদিন লাগবে-- সেটা নির্ধারণ করা কি খুব জটিল কাজ? নিশ্চয়ই না। যদিও এর বিপরীতে অনেকের ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে। তারপরও, গন্তব্যটা তো জানার অধিকার এ দেশের আমজনতার আছে।
মতিউর রহমান চৌধুরী তাঁর নিবন্ধে এও বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের ভেতরে রাজনৈতিক শক্তির উপস্থিতি না থাকায় সরকার এখনো নড়বড়ে, দুর্বল। দিক নির্দেশনাহীন।
পুরো নিবন্ধে এই কথাগুলোই সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। একটা দেশ চলে তার সংবিধানের আলোকে। আর সেই সংবিধান সংস্কার কমিশনে রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের অন্তর্ভুক্তি থাকাটাও জরুরি।
যে সংবিধানের আলোকে নির্বাচিত সরকারগুলো দেশ চালাবে, তার সংস্কারে অবশ্যই রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিত্ব থাকা আবশ্যক। ৬টি সংস্কার কমিশনে শিক্ষার্থী প্রতিনিধি রাখা হয়েছে (নাম ঘোষণা করা হয়নি)। রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি নেই। থাকাটা জরুরি ছিল। দেশে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল অনেক, সবাইকে রাখা সম্ভব না; এটাও বাস্তব। কিন্তু বড় ৫টি-৩টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি রাখা যেতে পারে। তাহলে সংস্কারগুলো পোক্ত হতো এবং আগামীতে নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় এলে তাকে পাল্টে ফেলার ভাবনাটা আসত না।
এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি তুলতেই হয়। এই যে সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে এবং সংস্কারও হলো; কিন্তু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসীন হবে, তারা যে এই সংবিধান আবার পাল্টাবে না-- তার নিশ্চয়তা কি? তাই সংস্কার যেন স্থায়ী হয় এবং সে ধারা যেন অব্যাহত থাকে-- এটা রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়েই নির্ধারণ করতে হবে। তা না হলে পুনঃসংস্কারের আশঙ্কাটা থেকেই যাবে।

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন